নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশে ইউনেস্কো ক্লাব
মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশে ইউনেস্কো ক্লাবের জাতীয় সংগঠন ১৯৮৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর একটি অলাভজনক অংশীদার সংস্থা হিসেবে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশন (বিএনসিইউ), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি তৃণমূল পর্যায়ে ইউনেস্কোর দক্ষতার ক্ষেত্রে কাজ করার উদ্দেশ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য হয়ে উঠেছে।
ইউনেস্কো ক্লাব এবং সমিতিগুলোর ফেডারেশন হল স্বেচ্ছাসেবকভিত্তিক সংস্থা যা স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইউনেস্কোর শান্তি, আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া এবং টেকসই উন্নয়নের আদর্শ প্রচার করে, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ সম্পর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ইউনেস্কোর আদর্শ প্রচারের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষামূলক কর্মশালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সম্প্রদায় পরিষেবা প্রকল্প এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারণা।
জাতীয় পর্যায়ে, ক্লাব ফর ইউনেস্কো নাগরিক সচেতনতাকে উৎসাহিত করে যা বিশেষ করে তরুণদের তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা বিশ্বজুড়ে ইউনেস্কোর ক্লাবগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ইউনেস্কো ক্লাবের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার জন্য দৃঢ়ভাবে কাজ করে আসছি। ইউনেস্কোর ক্লাবগুলোর লক্ষ্য এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্যমাত্রা, যা সেই সময়ের বৈশ্বিক অগ্রাধিকার, তার চারপাশে কাজ করে।
আমরা লক্ষ্যমাত্রার দ্বারপ্রান্তে থাকায়, আমাদের আরও গতিশীল গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এরইমধ্যে, আমরা অনেক মূল্যবান; কিন্তু অপরিহার্য কর্মকাল হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু বিশ্বব্যাপী সহানুভূতিশীল সম্পর্কের স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান পতন লক্ষ্য করেছি যা বিশ্ব শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তির উপর বাধা তৈরি করেছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি তার মধ্যে একটি হলো অংশীদারিত্বের মূল্য।
বিস্তৃত বৈশ্বিক দূষণ এবং উষ্ণায়নের অভিজ্ঞতায়, টেকসই স্থিতিস্থাপকতার প্রয়োজনীয়তা আবারও বিশ্বজুড়ে সর্বত্র অনুভূত হয়েছে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমাদের কর্মের স্থায়িত্বের উপর মনোনিবেশ করা দরকার এবং দেশগুলোর মধ্যে সংহতি বাড়ানোর জন্য আঞ্চলিক ক্লাবগুলোকে এখন সেই অনুযায়ী পুনর্গঠিত করা উচিত।
পরিবর্তিত চ্যালেঞ্জগুলির জন্য সদস্য ক্লাবগুলোকে পুনর্গঠন শুরু করেছে এবং ইউনেস্কো এবং জাতীয় কমিশনগুলোকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনেস্কো হচ্ছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (United Nations Educational Scientific and Cultural Organization)। প্রকারান্তরে যাকে বলা যায়, একটি আদর্শের নাম। আর এ জন্যই ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্রতিষ্ঠা হলেও মূলত: ১৯৪৬ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ইউনেস্কোর কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয় এবং এ যাবৎ ইউনেস্কো যা কিছু করে এসেছে এবং করছে, তা সবই হচ্ছে মানবজাতির মনে শান্তির আন্দোলনকে জোরদার করার অভীষ্ট প্রয়াস। ইউনেস্কো জাতিসংঘের বিশেষ ১৪টি সংস্থার মধ্যে অন্যতম।
শুধু শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই সীমায়িত নয়। গণমাধ্যম ও সমাজবিজ্ঞানের কর্মসূচিতেও পরিব্যাপ্ত।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের সন্নিকটে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দফতর অবস্থিত এবং মিস অদ্রি আজুলা সংস্থাটির বর্তমান মহাপরিচালক। ইউনেস্কো একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা, শুধু সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোই এর সদস্য হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালে ইউনেস্কোর সদস্যপদ লাভ করে। ইউনেস্কো সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তা হচ্ছে শিক্ষা। বর্তমানে ইউনেস্কোর দায়িত্বভার বহুগুণে বেড়ে গেছে। আজকের দিনে শিক্ষাকে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য শিক্ষা লাভ নিশ্চিত করা। গঠনতন্ত্র অনুসারে ইউনেস্কোর কর্তব্য হচ্ছে, ভাষা ও ছবির মাধ্যমে ভাবগত ধ্যান-ধারণার অবাধ বিনিময় নিশ্চিত করা। ইউনেস্কো তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি নীতিগুলো প্রণয়নে সহায়তা এবং শিল্প, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রসার ঘটিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে ব্যক্তি অধিকারের শাশ্বত বিষয়টিকে বাস্তব করে তুলতে সাহায্য করে।
ইউনেস্কো সব দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কাজ করে আসছে। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কর্মতৎপরতার সবচেয়ে বেশি পরিচিতি যে জন্য সেটা হচ্ছে, সংস্কৃতি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সম্পত্তি নয়, সংস্কৃতি সবার- এই উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করতে বিশ্বব্যাপী অবদান রাখার জন্য। ইউনেস্কো বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে আগ্রহী। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ইউনেস্কোর অবদান যথেষ্ট। ইউনেস্কোর যে কোনো প্রকল্প কর্মসূচি ও কার্যক্রম সাধারণত বিএনসিইউ ও বিভিন্ন এনজিও বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। ইউনেস্কোর উদ্দেশ্য ও আদর্শ নাগরিক সমাজ তথা যুব সমাজের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন তার কাজ শুরু কওে আসছে।
বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার সংরক্ষণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গণশিক্ষা কার্যক্রম, মাদক ও এইচআইভি এইডস্ বিরোধী আন্দোলন, যোগাযোগ, বিনিময়, গ্রুপ ভ্রমণ, প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা, কর্মশিবির, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপ এবং জাতিসংঘ দিবসগুলো পালন ও এর কর্মসূচির প্রসার সাধন, মেধাবী অথচ গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান এবং সর্বোপরি আদর্শ নাগরিক সৃষ্টি করা ছাড়াও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, বৃক্ষরোপণ, শিক্ষকদের মাঝে ‘সবার জন্য শিক্ষা’, গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট বিতরণ ও সেমিনার করে থাকে।
এছাড়া ইউনেস্কো ক্লাব সাংবাদিকতা পুরস্কার ও ইউনেস্কো ক্লাব শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা প্রবর্তনের মাধ্যমে অনেক শিশুশিল্পী ও মিডিয়া কর্মীদের তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভা বিকাশে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। ইউনেস্কো বই এবং প্রকাশনা প্রদর্শনী করা হয়। ইকোবানা বা ফুলের প্রদর্শনী এবং বাংলাদেশে ইউনেস্কো ঢাকা অফিস ও বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান ছাড়াও ইউনেস্কো ক্লাব প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের সহযোগিতায় শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপ-জেলাতে বেশ কতকগুলো ইউনেস্কো ক্লাবের শাখা রয়েছে। ইউনেস্কো কর্মক্ষেত্রে যেমন অতল তেমনি মহৎ।
১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রে এবং তার বাইরেও এই প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় এবং প্রায়ই আমরা তার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পারিনি। যে কোনো দেশের, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চায় ইউনেস্কো যে পরোক্ষ অথচ অমূল্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে তার তুলনা নেই। বাংলাদেশে ইউনেস্কো ও ইউনেস্কো ক্লাবের কার্যক্রম দিন দিন আরও ব্যাপকভাবে প্রসারিত এবং প্রশংসিত হবে- এটাই সবার কাম্য।
মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো ক্লাব এ্যাসোসিয়েশন
