ভারতে বাঙালি মুসলমানদের অনিশ্চিত জীবন

অতিশ আজিজ

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বছরের পর বছর গুরগাঁওয়ের (দিল্লির নিকটবর্তী একটি শহর) নির্মাণস্থল, বস্তি ও কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য শ্রমশক্তির ওপর, যারা মূলত পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চল থেকে আগত বাঙালি মুসলিম অভিবাসী শ্রমিক। অথচ আজ তারাই হয়ে উঠেছে সন্দেহের চোখে দেখা এক ‘অবাঞ্ছিত’ শ্রেণি। তাদের বারবার ‘রোহিঙ্গা’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে- যার ফলে তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’র তকমা পেয়েছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে কখনও হেনস্তা, কখনও জোরপূর্বক উচ্ছেদ, আবার কখনও নিঃশব্দে গায়েব করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। তারা এখন নিজেদেরই দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক ভূখণ্ডে, অনিশ্চয়তা ও ভয়ের মধ্যে বসবাস করছে।

বিভিন্ন শহরের বস্তিতে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রশাসনের তরফ থেকে কখনও বলা হচ্ছে এই এলাকায় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ লুকিয়ে আছে, কখনও তাদের আশ্রয়দাতা বলে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাভাষী ও মুসলিম পরিচয়কে সামনে এনে নাগরিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তথাকথিত ‘হোল্ডিং সেন্টারে’, যা কার্যত বন্দিশিবিরেরই অন্য নাম। এ প্রক্রিয়া শুধু প্রশাসনিক নয়, বরং ক্রমশ একটি ভয়ানক সামাজিক প্রকল্পে রূপ নিচ্ছে- যেখানে ভাষা, ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। যারা শহরের পরিকাঠামো নির্মাণের মূল কারিগর, তারাই আজ সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া মানুষ, যাদের নাগরিকত্ব হঠাৎ করেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত কয়েক বছরে গুরগাঁওয়ে যা ঘটছে, তা নতুন নয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এ বৈরী পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা এ অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন আজ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম, ঘরবাড়ি হারানোর ভয় এবং অদূর ভবিষ্যতের অন্ধকার সত্যিই সহানুভূতির দাবিদার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ মানুষদের ওপর বারবার চড়াও হয়েছে নানা ধরনের গোরক্ষক দল ও উন্মত্ত জনতা। তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা হয়ে উঠেছে তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। তাদের বাধ্য করা হয়েছে পালাতে, আর শেষমেশ নিজেদেরই রাজ্য তাদের সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছে। আজ হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের এক ভিন জায়গায় আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। কারণ তাদের নিজ রাজ্য আজও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাদের ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমি গুরগাঁওয়ের এক অভিজাত গেটেড আবাসন এলাকায় থাকি। ২৪ জুলাই সকালে প্রথম কাপ কফি খেতে খেতে একটি পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ছিলাম, যেখানে গুরগাঁও থেকে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের দলবদ্ধভাবে প্রস্থান নিয়ে লেখা ছিল। আমি নিজেই এ নির্বাসনের প্রত্যক্ষদর্শী। আমাদের রেসিডেন্ট গেটেড কমিউনিটিতে, জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যেই হাউজকিপিং কর্মীদের অর্ধেকেরও বেশি এরমধ্যেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাদের সঙ্গে চলে গেছেন স্বনির্ভর গাড়ি পরিষ্কারক, গৃহকর্মী, রাঁধুনি, আয়া, কুকুর হাঁটানোর কর্মী, ময়লা পরিষ্কার করা লোক এবং অন্যান্য নীল-কলার কর্মচারীরা। তারা রেখে গেছেন তাদের ভাড়ার ঘর, জিনিসপত্র, জামাকাপড়, সন্তানের পড়াশোনা, চাকরি ও ছোটখাটো কাজ। অর্থাৎ, তাদের প্রায় সবকিছু। আমি নিজেও একজন বাঙালি হওয়ায় এ সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি, বোঝার চেষ্টা করি, তারা কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে।

আমার প্রথম গন্তব্য ছিল সেক্টর ৪৯-এর শ্রীরাম ধাবার পেছনে একটি ছোট ফটো স্টুডিও কাম ফটোকপি দোকান। সেখানে ছবি তোলার জন্য ঢুকতেই দেখি, দোকানের বাইরে বেশ বড় একটি ভিড় জমেছে। দোকানদার আমাকে জানান, এ লোকজন মূলত এসেছে তাদের পরিচয়পত্রের ফটোকপি করাতে। কারণ, সম্প্রতি সব চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের আবারও পুলিশ ভেরিফিকেশন জমা দিতে বলা হয়েছে- তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ খোঁজার অভিযানের কারণে। ওই ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন আহতেশাম নামে এক তরুণ, বয়স আনুমানিক ৩৫। তিনি জানান, কাছাকাছি অবস্থিত জেএমডি বিল্ডিংয়ে হাউজকিপিং স্টাফ হিসাবে কাজ করেন। পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে তিনি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যান-পাশের টিকিট বুকিং সেন্টারে গিয়ে মালদায় ফেরার জন্য হাওড়া, শিয়ালদহ বা নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে একটা ট্রেনের টিকিট কাটবেন কি না। কেন? কারণ, সেদিন সকালেই, যে আবাসনে তিনি থাকেন, সেখান থেকেই মালদার চাঁচল গ্রামের এক তরুণকে পুলিশ ‘ডিটেইন’ করে নিয়ে যায়।

সে একজন টোটো (ই-রিকশা) চালক ছিল। আহতেশামের প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা অনুযায়ী, ছেলেটি তার পরিচয়পত্র দেখানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেগুলোর কোনো মূল্যই পুলিশ দেয়নি। তাকে মারধর করা হয়, গায়ে হাত তোলা হয় এবং এরপর দিল্লি-এনসিআরের একটি তথাকথিত ডিটেনশন সেন্টারে পুলিশের ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতেশামের ভয় হচ্ছিল, ‘পুলিশ পুনরায় যাচাইয়ের’ নামে হয়তো তাদের মতো অভিবাসী শ্রমিকদের আটকানো ও হয়রানি করার জন্যই ডাকা হচ্ছে। আরেকজন, সুনীল নামে এক ব্যক্তি, যিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছেন, তিনিও এই পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাকে আর্ধদিনের মজুরি খোয়াতে হবে- তার ওপর, কাগজে সিল পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারকে যে ‘ঘি’ খাওয়াতে হবে, সেটাও কম চাপের নয়। সেদিন দুপুরে আমাদের রাঁধুনী একজন স্নেহশীলা বাঙালি মুসলিম নারী, আমার স্ত্রীও আমাকে জানালেন, পরদিন সকালেই তিনি গুরগাঁও ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এ সিদ্ধান্ত তার জন্য সহজ ছিল না। তিনি এবং তার স্বামী শ্বশুরের ক্যান্সারের চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে এক বিশাল ঋণে ডুবে গেছেন। দুজনই দিনে ১৬ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন। ঋণ শোধ করার পাশাপাশি সংসার চালানো আর সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হয়। এখন সবকিছুই অনিশ্চিত।

আব্দুস সালামণ্ডপশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ মালদার এক বাসিন্দা।

সাত বছর আগে গুরগাঁও এসেছিলেন এ আশায় যে, কিছু টাকা জোগাড় করে ফিরে গিয়ে নিজের গ্রামে একটু জমি কিনবেন, চাষবাস করবেন, একটা ছোট দোকান দেবেন, আর শান্তিপূর্ণভাবে সংসার চালাবেন। তিনি আগে আরবান কোম্পানিতে ক্লিনার হিসাবে কাজ করতেন এবং তিনি কাজে ছিলেন অসাধারণ দক্ষ। এ দক্ষতাই তাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল-আরবান কোম্পানি ছেড়ে নিজে থেকে ফ্রিল্যান্স পরিষেবা দিতে শুরু করেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসটা খুব দ্রুত ভেঙে যায়। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ভয়ে তিনি ঠিক করেছেন গুরগাঁও ছেড়ে চলে যাবেন-আর তাই একটা বিমান টিকিট কেটে ফেলেছেন বাগডোগরার জন্য। এ লেখাটি শেষ করতে করতে আমি টিভি চালিয়ে দিই। হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে, অমিতাভ বচ্চন একটি বাসমতী চালের ব্র্যান্ডের প্রচার করছেন।

তার এককথার সংলাপ : আসুন, আমরা বিশ্বকে দেখাই কীভাবে ভারতে অতিথিকে দেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনটি নিঃসন্দেহে বেশ তামাশার মতো মনে হলো। হয়তো ওখানে ‘মেহমান’ বলতে বোঝানো হয়েছে সেইসব অতিথিকে, যারা সংখ্যালঘু নন এবং ভারতীয়ও নন, বরং তারা সেই দেশগুলোর নাগরিক, যাদের দিকে আজকের উচ্চবিত্ত শ্রেণি অভিবাসনের স্বপ্নে চেয়ে থাকে।

লেখক : স্থানীয় পেশাজীবী, প্রাবন্ধিক