হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্য

সাকী মাহবুব

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে- যে আমার জন্মভূমি’ - কবির এই অমর বাণী আজ প্রশ্নের মুখে। বাঙালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন, প্রযুক্তির অতিব্যবহার এবং নতুন প্রজন্মের বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। এই ফিচারে আমরা আলোচনা করব কীভাবে আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, এর পেছনের কারণগুলো এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ সম্পর্কে। বাংলাদেশে সংস্কৃতির বিলুপ্তির হার উদ্বেগজনক। একটি গবেষণায় দেখা গেছে: ৮৫% গ্রামীণ খেলা (হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি) এখন আর চর্চা হয় না। ৭০% ঐতিহ্যবাহী পিঠার প্রকারভেদ নতুন প্রজন্মের অজানা ৬৩% ভারতীয় বাবা-মা (এবং বাংলাদেশেও অনুরূপ) টিভি অনুষ্ঠানে যৌনতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ চান। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে লোকজ খেলাধুলা ও বিনোদন।

‘আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু। আমার মনে হয় আমরা সেটা শুধু বই পড়েই জেনেছি মাত্র। নতুন প্রজন্ম আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু খেলা চোখে দেখেছে বলে মনে হয় না।’ গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে গোল্লাছুট, কানামাছি, দাড়িয়াবাঁধা, ডাংগুলি, মার্বেল খেলা আজ বিলুপ্তির পথে । জব্বারের বলি খেলা, মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই এখন শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানেই দেখা যায় । আগে পাড়ায় মহল্লায় কিংবা বটতলায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসত বাউলদের মন মাতানো গানের আসর’। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, পালাগান, যাত্রাপালা, কবিগান আজ শুধু স্মৃতি। বায়োস্কোপ, পুতুলনাচের মতো লোকজ বিনোদনও বিলুপ্তপ্রায়। ঢেঁকিতে ধান ভানা, নকশি কাঁথা সেলাই, পালকিতে বিয়ে, গরুর গাড়ির ব্যবহার- এসব দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। নবান্ন উৎসব, পৌষ পার্বণসহ ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে।

জিন্স, টি-শার্ট পোশাকে বোঝাই যায় না নারী না পুরুষ এমন একশ্রেণির কালচার গ্রহীদের। অন্যদিকে, ‘হাজার রকমের বিদেশি খাবারের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আতিথিয়তার ঢং। এ সকল সংস্কৃতি বিলুপ্তির কারণ : বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন। ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত অপসংস্কৃতির এই আগ্রাসন থেকে বাঙালির চিরায়ত সভ্যতা বাঁচাতে আমাদের মিডিয়াকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে এখনই’। স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি-বাংলার মতো চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানে পারিবারিককলহ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তির অতিব্যবহার শিশু-কিশোরদের মধ্যে এখন হাতে হাতে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ কম্পিউটার। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মগ্ন থাকায় লোকজ সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। যৌথ পরিবার প্রথা, সামাজিক বন্ধন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। একক পরিবার গড়ে উঠছে। এর ফলে সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ কমে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশীয় সংস্কৃতির যথাযথ স্থান নেই। ফলে নতুন প্রজন্ম তাদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

এ থেকে মুক্তির উপায়- দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। আর এসব বাস্তবায়নে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। ‘দেশীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও দেশের ঐতিহ্য নিয়ে সবার ভেতরে সচেতনতা থাকতে হবে।’ ‘আমাদের মিডিয়াগুলোও ভারতীয় চ্যানেলের অনুকরণে বিভিন্ন অপরাধ অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান তৈরি করছে। এসব বন্ধ করে দেশীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠান নির্মাণে কাজ করতে হবে।’ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির দীর্ঘদিনের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত মানবিক মূল্যবোধ, যা সুন্দরের পথে, কল্যাণের পথে এগিয়ে চলে। আমাদের সংস্কৃতি শুধু অতীতের গৌরব নয়, ভবিষ্যতের পাথেয়ও বটে।

তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সন্তানদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ তৈরি করি। মনে রাখতে হবে, ‘ধর্ম ও বিশ্বাস যার যার; কিন্তু সংস্কৃতি ও উৎসব সব বাঙালির।’

সহকারী শিক্ষক

নাদির হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়