বহতা নদীর মতোই কি হারিয়ে যাবে পাটশিল্প

অজেয় রোহিতাশ্ব আল-কাযী

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা সব প্রবাদ-প্রবচন কি আদতে সঠিক নয়? যেমন ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ প্রবচনটির সর্বময়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেননা চোর পালানোর সময় ঘরে আগুন দিয়ে গেলেও কিছু অকর্মণ্য তখন ‘পি-পু, ফি-শো’ (পিঠ পুড়ছে, ফিরে শো) মুডে চলে যায়।

দুই দশক ধরেই যখন বাংলাদেশ ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ দুর্বার গতিতে ধাবমান, তখন অনেক রাষ্ট্রচিন্তকই প্রশ্ন তুলেছিলেন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত নিয়ে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা মূলত আয় হয় দুটি খাত থেকে ক. রেমিট্যান্স এবং খ. তৈরি পোশাক রপ্তানি। বারবার বলা হচ্ছিল পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে, কখনও যদি বিদেশে শ্রমিক নেওয়া হ্রাস পায় বা ওই দেশে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দেয়, ১৮ কোটির বাংলাদেশ ভুগবে। কিংবা যদি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কর নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনে, তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত শুধু মুখ থুবড়েই পড়বে না, সৃষ্টি হবে ব্যাপক বেকারত্বের, যা রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থাকে হুমকির সম্মুখীন করবে। অর্ধ বধির নেতৃত্ব, কানে তো শোনেনইনি, অনুধাবনও করেননি। কেননা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ তৈরি হলেও প্রচলিত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ‘রাষ্ট্রনায়ক’ তৈরি করতে অপারগ। আর এই প্রথাগত রাজনীতির বেড়াজাল ভেঙে যে রাষ্ট্রনায়ক এসেছিলেন, তিনি ছিলেন ক্ষণজীবী। ফলে সড়কে উঠলেও এগোনো হয়নি বাংলাদেশের!

ট্রাম্প জানুয়ারি ২০২৫-এ শপথ নেওয়ার পর থেকে শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জানেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর পাল্লায় পড়ে অনেক কিছুই বদলাবে, তোলপাড় হবে বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্ববাণিজ্যে। সন্ত্রস্ত বিশ্বনেতারা সতর্ক হলেও এ দেশে এই জাতি তখন হাজার কোটি বিডা খোয়াবে মগ্ন, প্রেজেন্টেশনে মুগ্ধ। আন্দাজ করা যেতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কর আরোপিত হওয়ার ৯০ দিনের মাথায় অনেক তৈরি পোশাক কারখানাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে, বেকার হয়ে যাবেন অন্তত পাঁচ থেকে আট লাখ শ্রমিক। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্ভাব্য দুর্বিপাক কি অনিবার্য ছিল? এটি কি এড়ানো যেত না? প্রথমত, এই দুর্বিপাক আদৌ ‘দুর্বিপাক’ হতো না, যদি এ দেশের নেতৃত্ব অবিমৃশ্যকারী না হতো। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত হতে পারত পাটজাত পণ্য, পর্যটন এবং চামড়াজাত পণ্য। পাটজাত পণ্যের কথাই বলা যাক, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাট উৎপাদিত হয়েছিল ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৬০ টন এবং বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৯ লাখ আট হাজার টন (সূত্র : ডিএই, বিবিএস এবং ইপিবি)

প্রতি টন পাটজাত পণ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পাটবর্জ্য তৈরি হয়, অর্থাৎ ইপিবি তথ্যানুযায়ী ৯ লাখ আট হাজার টন রপ্তানি করা পাটজাত পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে ৯০ হাজার ৮০০ টন পাটবর্জ্য হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে মোট পাট ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৮০০ টন অথচ বিবিএস এবং ডিএইর তথ্যানুযায়ী পাট উৎপাদিত হয়েছে ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৬০ টন, মাঝখানের সাত লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ টন পাট গেল কোথায়? এই সোয়া সাত লাখ টন পাট, পাটমূল্য অর্থাৎ গড়ে তিন হাজার টাকা মণ দরে, টনে ৭৫ হাজার টাকা গড়মূল্যে রপ্তানি হয়েছে। সেই অর্থবছরের পাটজাত পণ্যের টনপ্রতি গড় রপ্তানিমূল্য ছিল এক লাখ ১১ হাজার ৯২৫ টাকা (ডলার মূল্য ১২১ টাকা ধরে)।

অর্থাৎ প্রতি টনে বাংলাদেশ আয় হারিয়েছে ৩৬ হাজার ৯২৫ টাকা বা ৩০৫ মার্কিন ডলার অর্থাৎ মোট দুই কোটি ২১ লাখ ৭২ হাজার ২৮০ মার্কিন ডলার (পাটবর্জ্য ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে)। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই বাংলাদেশের উপার্জন। কেননা এ খাতে কোনো ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় মেটাতে হয় না। কাঁচামাল বাংলাদেশের, বিদ্যুৎ বাংলাদেশের, শ্রমিক বাংলাদেশের। তৈরি পোশাক খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যাক টু ব্যাক এলসির কারণে অন্য দেশে চলে যায়, তা পাটশিল্পে ঘটে না। উপরন্তু তৈরি পোশাক খাতের মতোই পাটশিল্পও শ্রমঘন শিল্প। ফলে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের দিক দিয়েও পাটশিল্প দ্বিতীয় বিকল্প হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তাহলে হয়নি কেন? প্রথমত, বৈশ্বিক বাজারে কখনোই পাটপণ্যের দেশ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেনি বাংলাদেশ, সর্বসময়ে সব পাট ও বস্ত্র মন্ত্রীই তার মন্ত্রণালয়ের বস্ত্র খাতকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, পাটকে ততটা দেননি। ফলে এগোয়নি পাট খাত। দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তারাও উৎসাহিত হননি।

কেননা পাট খাতে রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট খুব ধীর, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় নয়। তৃতীয়ত, ২০২৪-এর জানুয়ারিতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানির ওপর প্রদত্ত ‘নগদ প্রণোদনা’ হ্রাস করে সরকার, যার সরাসরি ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে মুনাফায়। ২০২৪-এর জুলাই থেকে এই নগদ প্রণোদনা আরও হ্রাস করা হয়। ফলে অনেক ব্যবসায়ীই উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মুনাফা হ্রাসের কারণে উৎপাদনও হ্রাস করেন। সর্বোপরি ২০২৪-এ পাটের ভরা মৌসুমে ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের’ ঘোষণা পাট বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে, পাটের মূল্য আসমান ছুঁলেও আন্তর্জাতিক বাজারে দর তেমন একটা বাড়েনি পাটজাত পণ্যের। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহৃত হয়নি পাটজাত পণ্য। নগদ প্রণোদনার ক্রম হ্রাসমান গতি এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের শোকেসিংয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব পাটশিল্পকেই অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছে আজ। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক নির্ধারিত হয় বহতা পানির ওপর শ্বেতশাপলা, দুই পাশে ধানের ছড়া, চারটি তারকা এবং পাটের তিনটি পাতা।

পৃথিবীর সব দেশেই তার ন্যাশনাল এমব্লেম বা জাতীয় প্রতীক সংক্ষেপে সে দেশের পরিচয় তুলে ধরে, বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরাও আদতে ঠিক সেই কাজটি করেছিলেন... নদীমাতৃক দেশ বলে জাতীয় প্রতীকে বহতা পানি আছে। শ্বেতশাপলা, যা এ দেশের জলাশয়ে সুলভ, তা এ দেশের মানুষের শান্তিপ্রিয়তার প্রতীক। ভাত এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। তাই দুই পাশে ধানের শীষ। সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ চার তারকা আর শীর্ষে বা সবার ওপরে প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের পাতা। স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধিরা যে বাস্তবতা বুঝেছিলেন, সেই বাস্তবতা পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হয়ে আজ প্রায় হারানো অতীত। বহতা নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়, আর পাটশিল্প?

লেখক : মুখ্য কর্মকৌশল কর্মকর্তা