আমাদের ড্রেনগুলো মরণফাঁদ কেন?

সমীরণ বিশ্বাস

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে ড্রেনে পড়ে মানুষের মৃত্যু মর্মান্তিক ও লজ্জাজনক বাস্তবতা। আধুনিক যুগে যখন প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও নাগরিক সেবার উন্নতির কথা বলা হচ্ছে, তখন শহরের বুক চিরে বয়ে চলা উন্মুক্ত ও অব্যবস্থাপনায় ভরা ড্রেনগুলো যেন এক-একটি মৃত্যুকূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে মানুষ যখন রাস্তায় বের হয়, তখন সে কি জানে, ফিরে নাও আসতে পারে?

শিশু, বৃদ্ধ, নারী, এমনকি কর্মজীবী মানুষ, সবাই এই ঝুঁকির মুখোমুখি। বৃষ্টির সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া খোলা ম্যানহোল বা ড্রেন যেন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়। চোখের সামনে প্রিয়জন ড্রেনে তলিয়ে গেলে শুধু একজন নয়, ভেঙে পড়ে পুরো পরিবার, পুরো সমাজ। এই মৃত্যু শুধু দুর্ঘটনা নয়, এটি দায়িত্বহীনতার ফসল। ঠিক, কত প্রাণ গেলে আমরা জাগব? একটিবার কি আমরা ভাবি, এই ড্রেন বন্ধ, নিরাপদ, সুরক্ষিত হলে প্রাণটা বাঁচতো? প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষের জীবনের মূল্য যেন আর কোনো খোলা ড্রেনের নিচে চাপা না পড়ে।

ঢাকনা নেই বা নষ্ট ড্রেন কভার : অনেক ড্রেনের ওপর স্ল্যাব বা ঢাকনা থাকে না, আবার কোথাও সেটা ভাঙা বা সরিয়ে রাখা হয়। এতে মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও পথচারী হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হয় বা মারা যায়।

অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব : অনেক বছর ধরে ড্রেনগুলোর কোনো সংস্কার হয় না। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ড্রেন ব্লক হয়ে থাকে এবং দুর্ঘটনা আরও বাড়ে।

বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ড্রেন আচ্ছাদিত হয়ে যায় : ভারী বর্ষণে ড্রেনগুলোর অবস্থান বোঝা যায় না। ফলে মানুষ চলাচলের সময় হঠাৎ পড়ে গিয়ে ডুবে মারা যেতে পারে।

অপরিকল্পিত ড্রেন নকশা ও নির্মাণ : অনেক জায়গায় ড্রেন গভীর ও খোলা রেখে চলে যায়, কোনো রেলিং বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। কোনো জায়গায় সড়কের সঙ্গে ড্রেনের উচ্চতার পার্থক্য নেই, যা বিপজ্জনক। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, এমনকি কর্মজীবী মানুষ, সবাই এই ঝুঁকির মুখোমুখি। বৃষ্টির সময় পানিতে তলিয়ে যাওয়া খোলা ম্যানহোল বা ড্রেন যেন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়।

ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর : ড্রেনে প্লাস্টিক, পলিথিন, ময়লা ফেলে আটকে ফেলা হয়। এই আবর্জনার স্তূপে পা পিছলে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রশাসনিক উদাসীনতা : স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সিটি কর্পোরেশন অনেক সময় অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নেয় না। জননিরাপত্তার ব্যাপারে অবহেলা দেখা যায়।

রাতের অন্ধকারে বিপদ আরও বেশি : রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো না থাকলে খোলা ড্রেন দেখা যায় না। ফলে রাতে চলাচলের সময় প্রাণ হারানোর ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

কেন ড্রেনে গ্যাস জমে : মূল কারণ হলো ড্রেনে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি ও জমাট বাধা, যা বিষাক্ত ও দাহ্য (জ্বলনশীল) হতে পারে।

জৈব বর্জ্যরে পচন : নালা বা ড্রেনে আবর্জনা, খাবারের উচ্ছিষ্ট, মৃত প্রাণী, পাতা ইত্যাদি জমে। এগুলো পচে মিথেন (CH?), হাইড্রোজেন সালফাইড (H?S), কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO?) ইত্যাদি গ্যাস তৈরি করে।

এয়ার ফ্লো বন্ধ থাকা : ড্রেনের মুখ বা পথ অনেক সময় ময়লা, সিমেন্ট, ইট বা আবর্জনা দিয়ে বন্ধ থাকে। ফলে, এই গ্যাসগুলো বাইরে বের হতে না পেরে ভেতরে জমে যায়।

সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা : শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ড্রেনে ফেললে বিপজ্জনক গ্যাস তৈরি হয়। আবার এই বর্জ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিষ্কার করা না হলে তা গ্যাসে রূপান্তরিত হয়।

কোন গ্যাসগুলো ঝুঁকিপূর্ণ : মিথেন (CH?) গ্যাস জ্বলনশীল বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। হাইড্রোজেন সালফাইড (H?S) দুর্গন্ধযুক্ত, বিষাক্ত। শ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে, অচেতন বা মৃত্যু ঘটাতে পারে। কার্বন মনোঅক্সাইড (CO) রংহীন, গন্ধহীন, অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত করে মৃত্যু ঘটায়।

ড্রেনের গ্যাসে মৃত্যুর কারণ : অক্সিজেনের অভাব, গ্যাসগুলো অক্সিজেনের জায়গা দখল করে নেয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। হঠাৎ বিষক্রিয়া, গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে গেলে মাথা ঘোরা, বমি, অজ্ঞান ও মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণ, গ্যাসের ঘনত্ব বেশি হলে আগুনের স্ফুলিঙ্গেই বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় : ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। ড্রেনপথ খোলা ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা। গ্যাস জমার শঙ্কা থাকলে আগে ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা। ড্রেনে নামার আগে নিরাপত্তা গিয়ার ও মাস্ক ব্যবহার করা। জনগণের সচেতনতা বাড়ানো।

উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা : উন্নত দেশগুলোয় নিরাপদ ড্রেনেজ ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হয়। সেসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনেক শিক্ষণীয় দিক রয়েছে।

উন্নত দেশগুলোর নিরাপদ ড্রেন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : আবদ্ধ ও ঢাকনা যুক্ত ড্রেন : খোলা ড্রেন নেই বললেই চলে। কংক্রিট বা লোহার ঢাকনা দিয়ে বন্ধ রাখা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সহজেই খোলা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য ঝুঁকিহীন।

নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা : সময়সীমা অনুযায়ী নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। স্বয়ংক্রিয় বা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় (যেমন ভ্যাকুয়াম ট্রাক)।

গ্যাস নির্গমনের ব্যবস্থা : ম্যানহোল ও ড্রেন লাইন থেকে বিষাক্ত গ্যাস বের হওয়ার নিরাপদ পথ রাখা হয়। গ্যাস সেন্সর ও মনিটরিং সিস্টেম থাকে অনেক শহরে।

নকশাভিত্তিক পরিকল্পনা : নগর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ডিজাইন করা হয়। অতিবৃষ্টির সময়েও যেন রাস্তায় পানি না জমে, সেইভাবে স্টর্মড্রেন (একধরনের ড্রেন বা নিষ্কাশন ব্যবস্থা; যা মূলত বৃষ্টির পানি, ঝড়ের পানি বা সড়কে জমে থাকা পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হয়) থাকে।

জনসচেতনতা ও আইন : জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কড়া আইন রয়েছে ড্রেনের মুখে আবর্জনা না ফেলার জন্য। দোষী ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়।

আমাদের শিক্ষণীয় দিকসমূহ : খোলা ড্রেন বন্ধ করা, ধাপে ধাপে সব খোলা ড্রেন ঢাকনা দ্বারা আবদ্ধ করা। নগর পরিকল্পনায় ড্রেন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, অপরিকল্পিত নির্মাণে বাধা দেওয়া।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, যাতে ড্রেন জ্যাম না হয়। প্রযুক্তিনির্ভর পরিচ্ছন্নতা, ম্যানুয়াল ক্লিনিং বাদ দিয়ে যন্ত্র ব্যবহারে যাওয়া। মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যারা ড্রেনে কাজ করেন, তাদের জন্য নিরাপদ পোশাক, গ্যাস সেন্সর ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। আইনি কাঠামো জোরদার, অবহেলায় মৃত্যু ঘটলে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। উন্নত বিশ্বের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে, যদি আমরা পরিকল্পিত ও প্রযুক্তিভিত্তিক ড্রেন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হই, তাহলে বহু জীবন রক্ষা সম্ভব হবে। এই মৃত্যু শুধু দুর্ঘটনা নয়, এটি দায়িত্বহীনতার ফসল। ঠিক, কত প্রাণ গেলে আমরা জাগব? একটিবার কি আমরা ভাবি, এই ড্রেন বন্ধ, নিরাপদ, সুরক্ষিত হলে প্রাণটা বাঁচতো? বাংলাদেশে ড্রেন শুধু ময়লা নিষ্কাশনের পথ নয়, দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনা ও নকশাগত ত্রুটির কারণে এগুলো এখন মানুষের জীবননাশের ‘মরণ ফাঁদ’-এ রূপ নিয়েছে।

জনসচেতনতা, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা কভার ও কর্র্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা ছাড়া এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

ড্রেনে গ্যাস জমার পেছনে প্রধান কারণ হলো বর্জ্য পচনের ফলে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি ও আটকে থাকা। এসব গ্যাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি করে। তাই নিয়মিত পরিষ্কার, সচেতনতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাই একমাত্র উপায়।

লেখক : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ