মূল্যস্ফীতি : আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন
মো. আকতার হোসাইন
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শেষই হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় পণ্য বা সেবার দাম বেড়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে টাকার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। যেমন ধরেন, গত বছর ঠিক এই সময় চালের বাজারমূল্য ছিল ৫০ টাকা কেজি, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ওই চালের বর্তমান বাজারমূল্য ৬০ টাকা কেজি। সুতরাং এখানে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ টাকা বা ২০ শতাংশ এবং ১০০ টাকার মূল্যমান হয়েছে ১২০ টাকার সমান। এই একটি বছরকে যদি ভিত্তি হিসেবে চিন্তা করা যায়, তাহলে একজন কর্মজীবীর আয় কখনওই বাড়েনি বা বাড়লেও ২০ শতাংশ কখনওই হয়নি। কিন্তু ওই ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করার জন্য ঠিকই ব্যয় বৃদ্ধি পেল। এ কারণেই মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেটে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কিভাবে সংকোচনমূলক কৌশল ও জনসাধারণের জীবনের ভারসাম্য বজায় রেখে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। এরইমধ্যে গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে ৩.৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্য মেয়াদে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।’ অর্থ বিভাগের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা মূল্যস্ফীতিকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে।
মূল্যস্ফীতির ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছরে সাধারণ করদাতাদের আয়করে ছাড় দেওয়া হয়নি। বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ছে। তবে দেশের প্রেক্ষাপটে আয়কর খাতে রাজস্ব বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং হওয়ায় খড়ুগ গিয়ে পড়ে ভ্যাটে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অনেক কারণ রয়েছে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। সঙ্গে যোগ দেয় বিগত সরকারের অদক্ষতার অন্যতম হলো প্রসারিত মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার। প্রসারিত মুদ্রানীতির কারণে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, দ্রব্যমূল্যও বৃদ্ধি পায়, যদিও মন্দা থেকে সাময়িক মুক্তি ঘটে। অন্যপক্ষে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে টাকার প্রকৃত মানকে কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়। সরকার আমদানি সীমিত করে। ফলে অনেক পণ্যের আমদানি বিঘ্নিত হয় এবং পরিণামে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়। তার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তবে গত ডিসেম্বরে যেখানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭৯ শতাংশ এবং খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৯২ শতাংশ, বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে গত জুনে ৮.৪৮ শতাংশে এসেছে। এমন অবস্থায় জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ এবং গত ৩১ জুলাইয়ে ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা সত্যি উচ্চাভিলাষী চিন্তা-ভাবনা। জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি, বরং সেখানে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের ওপরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের গৃহীত মুদ্রানীতিও সংকোচনমূলক এবং নীতি সুদ হার করা হয়েছে ১০ শতাংশ। এসব কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমে যাবে, বিনিয়োগ হ্রাস পাবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, বেকারত্ব বেড়ে যাবে, তবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে কি না সে সংশয় থেকেই যায়। বিষয়গুলো এতটাই পারস্পরিক যে কোনো একটি বিষয় বাড়লে বা কমলে অন্যটির হেরফের হবেই।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
