নেতাকে মানুষের ভালোবাসা পেতে হবে

শেখ রফিক

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোরবানির ঈদে বাড়ি গিয়েছিলাম- স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পারে, সাংরেঙ্গকাঠি ইউনিয়নের বিষ্ণুকাঠি গ্রামে, আমার শৈশবের হাজারো স্মৃতিঘেরা পুরোনো ভিটামাটি। বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে হেঁটে গেলে একটি হাট বসে- তার নাম করফার হাট। অনেক দিন পর সেই হাটে গেলাম। ঠিক তখনই হাটের মধ্যে ঢুকলেন এক মাঝবয়সি মানুষ- দুলাল হালদার। লোকজন তাকে সালাম দিল, আদাব দিল, দোকানিরা হাসিমুখে তাকাল। আমার বড় ছেলে সব্যসাচী জিজ্ঞেস করল, ‘আব্বু, উনি কে?’ আমি মুচকি হেসে উত্তর দিলাম, উনি দুলাল হালদার- এই এলাকার মেম্বার। মানুষের বিপদের সময় পাশে দাঁড়ান। তাই মানুষ তাকে চেনে, ভালোবাসে।

এরই মধ্যে দুলাল এসে জড়িয়ে ধরলেন। কুশল জিজ্ঞেস করে আমার দুই ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ‘সব্যসাচী, এসএসসি পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সক্রেটিস, তুমি কোন ক্লাসে পড়?’ ওরা দুজন বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকাল। ছেলেদের বুঝতে আর দেরি হলো না- দুলাল আমার বন্ধু। হ্যাঁ, দুলালকে পালিয়ে যেতে হয়নি। কারণ তিনি একজন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি। তিনি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। এটাই রাজনীতির আসল রূপ- মানুষের আস্থা অর্জন করা। নামের আগে ‘নেতা’ যুক্ত করলেই কি একজন মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হয়? এই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান- ‘আপনি কিসের নেতা?’

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে দলীয় নেতাদের বড় অংশই গণমানুষের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন, সেখানে এই প্রশ্ন সময়োপযোগী এবং চেতনায় ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। তারেক রহমান সরাসরি বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী হিসেবে আপনার পেছনে যদি পাবলিকই না থাকে, তাহলে কিসের রাজনৈতিক নেতা! কিসের রাজনৈতিক কর্মী! আপনি নামসর্বস্ব নেতা। এতে লাভ আছে কোনো? ওরকম নেতা হয়ে কোনো লাভ নেই।’ তিনি বলেন, ধরেন আপনার নাম হচ্ছে হিরণ কুমার, এই হিরণ কুমার আপনি একা শুধু? আরও শত শত, হাজার হাজার হিরণ কুমার নেই? খেয়াল করে দেখেন তো, হিরণ কুমার হিসেবে আপনি যখন বের হন- মানুষের সালাম বা সম্মান যেটা আপনি পান, আপনার মতো অন্য হিরণ কুমার সেটা কি পাচ্ছে? তাদের কেউ চেনেই না। কিন্তু আপনি কেন পাচ্ছেন? আপনি এ জন্য পাচ্ছেন যে আপনি এই দলের (বিএনপি) একজন নেতা, সে জন্য কিন্তু আপনি সম্মান পাচ্ছেন, দশটা মানুষের সালাম পাচ্ছেন। এখন ভাই, কথাটা হচ্ছে- দশটা মানুষ কেন সালাম দিচ্ছে? দশটা মানুষ সালাম দিচ্ছে যে, আপনি বিপদে-আপদে হোক বা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কাজ করেন, চিন্তা করেন। কিন্তু আপনি যদি এমন কোনো কাজ করেন, যেটাতে সে আঘাতপ্রাপ্ত হবে, সে কি আপনার পেছনে থাকবে? সে যদি আপনার পেছনে না থাকে, তাহলে আপনি কিসের নেতা? তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রাখতে চাইছে, আমাদের ওপরে অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ওপরে। এই আস্থা যদি নষ্ট করার জন্য কেউ কোনো কাজ করে, তাহলে ভাই, তাকে তো আমার পক্ষে টানা সম্ভব না। তাকে শেলটার আমি দেব না। এখানে দলকে স্বার্থপর হতেই হবে। আমাদের পক্ষে আর সম্ভব না- যে কেউ নিজের বিষয়, নিজের স্বার্থ নিয়ে এমন কিছু করবে, যেটা দলের স্বার্থকে আঘাত করবে, ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তাকে আমাদের পক্ষে টানা সম্ভব না।’ এমনই স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন তারেক রহমান। আত্মশুদ্ধির জায়গা থেকে তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভুল করেছে, বিভ্রান্ত হয়েছে, আপত্তিকর কাজ করেছে। আমরা তাদের সঙ্গে দলের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। এতে কী হবে- সেটা সময় বলবে। কিন্তু আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি।’ এই বক্তব্যের গভীরে রয়েছে রাজনৈতিক জবাবদিহি। যেখানে অন্য দলগুলো অপরাধীকে আড়াল করে, সেখানে তারেক রহমান জানিয়ে দিচ্ছেন- ‘যেটুকু জানি, সেটুকুর ভিত্তিতেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা চাই না, অন্যায়ের সঙ্গে কোনো রকম আপস হোক।’ তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছেন- ‘সমাজে সব সময় ভালো-মন্দ মানুষ থাকবে। কিন্তু আমরা যারা অন্যায় করে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না।’ এই কথার মধ্যে রয়েছে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের পরিচয়। এটাই একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতার বৈশিষ্ট্য। এই বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত তখনই আসে, যখন তিনি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কথা বলেন। যদি বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই শুদ্ধির প্রক্রিয়া শুধু দলীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা বিস্তৃত হবে প্রশাসনে, আইনের শাসনের ভেতরে। তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা যাদের অন্যায়ের কারণে দল থেকে বের করে দিচ্ছি, সরকারে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতাম। ভবিষ্যতে সেই অবস্থানে গেলে আমরা তা করব- এর কোনো নড়চড় হবে না।’ এই বক্তব্যে একজন রাজনৈতিক নেতার যে সাহস, স্বচ্ছতা এবং জন-আস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয়, তা আজকের রাজনীতিতে বিরল। এ এক ধরনের রাজনৈতিক নৈতিকতা, যা ভোট বা স্লোগানের জন্য নয়, বরং একটি নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন বিশ্বাস সংকট, নেতৃত্ব সংকট এবং আদর্শ সংকট ঘনীভূত, তখন তারেক রহমানের এই বক্তব্য আশার আলো দেখায়। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন- ‘নেতৃত্ব মানে শুধু পদ বা অবস্থান নয়, নেতৃত্ব মানে দায়, নেতৃত্ব মানে মানুষের আস্থা রক্ষা ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন।’ বিগত দিনে ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্বের বড় একটি অংশ জনকল্যাণ নয়, ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থেই নিয়োজিত ছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অনিয়ম শুধু অর্থনীতিকে নয়, ন্যায়ের বোধকেও ধ্বংস করেছে। বর্তমানে ‘জননেতা’ বা ‘বিপ্লবী নেতা’ নামে যাদের পরিচয় দেওয়া হয়, তাদের অনেকের সঙ্গেই জনগণের কোনো বাস্তব সংযোগ নেই। তারা মূলত কমিটির পদধারী নেতা। এ ধরনের নেতারা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান না, বরং সময় ব্যয় করেন দলীয় লবিং, পদণ্ডপদবি আর প্রভাব বিস্তারে।

একসময় জনপ্রতিনিধি হলেও তারা জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেন। ফলে রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল হয় আর ক্ষমতা সীমিত গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে, যা স্বৈরশাসনের জন্ম দেয়। এই অবস্থার উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। জনগণের সমস্যার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। যুবসমাজ ও নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আদর্শিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সবার আগে প্রয়োজন এমন জননেতা, যিনি সত্যিকার অর্থে জনগণের কথা ভাবেন আর তাদের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর মধ্যে থাকে নৈতিকতা, আদর্শ ও আন্তরিকতা। তিনি তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও প্রস্তুত থাকেন। রাষ্ট্র বদলাবে তখনই, যখন নাগরিকরা নিজেদের বদলাবে। চিন্তার দৈন্য, আত্মতুষ্টি আর প্রশ্নহীনতা- এই তিন রোগেই ভুগছে আজকের বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান বলেন, ‘আগে নিজেকে সংশোধন করুন, তারপর অন্যকে বলুন।’ তিনি বিএনপির নেতৃত্বকে আদর্শ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে যুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। শুধু দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেননি, বরং ভুলের শুদ্ধি এবং নেতাদের ব্যক্তিগত চরিত্রকে দলের স্বার্থের ওপরে না তোলার বার্তা দিয়েছেন।

লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক