মানবিক ও উদারনৈতিক শিক্ষার ভবিষ্যৎ

নূরে আলম সিদ্দিকী

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ, যাতে যে কোনো ধরনের অন্যায়, অবিচার আর অশুভ তৎপরতার ওপর মানবতা ও মানবিকতার আধিপত্য বজায় থাকে। যে কোনো মূল্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত না রাখা গেলে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

উদারনৈতিক শিক্ষা এবং উদার সাংস্কৃতিক জীবনাচার হচ্ছে ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞানের মতো কিছু একাডেমিক বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যা আঞ্চলিকতা, গোঁড়ামি, পুরোনোকে আঁকড়ে থাকা এবং অযৌক্তিক মতাদর্শ থেকে মানুষকে মুক্ত করে যৌক্তিক করে তুলতে সহায়তা করে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত মানুষ ইনসাফ সম্পর্কে সচেতন থাকেন, কর্মকাণ্ডে তারা বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান কলেজেস অ্যান্ড ইউনিভার্সিটিসের মতে, উদার শিক্ষা হলো শিক্ষার একটি দর্শন, যা বিস্তৃত জ্ঞান ও হস্তান্তরযোগ্য দক্ষতার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতাবান করে এবং শক্তিশালী মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও নাগরিক সম্পৃক্ততার একটি শক্তিশালী অনুভূতি তৈরি করে; যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কোনো কোর্স বা বিষয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার বহুমুখীকরণের দিকে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। সাধারণত আমরা উদার শিক্ষার পরিধিকে অনেক বেশি বৈশ্বিক এবং বহুত্ববাদী হিসেবে দেখি।

সিএনএন হোস্ট, ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট ফরিদ জাকারিয়া তার সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘ইন ডিফেন্স অব লিবারেল এডুকেশন’-এ মানবিক ও উদারনৈতিক শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবান এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, বর্তমান বিশ্বে লিবারেল আর্টস বা উদারনৈতিক শিক্ষা আক্রমণের মুখে রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালে শিক্ষার্থীদের এ কথা মনে রাখতে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে প্রকৌশল শিক্ষা যেকোনো মানবিক বা উদারনৈতিক শিক্ষা বা ইতিহাস শিক্ষার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফরিদ জাকারিয়া শিক্ষার্থীদের প্রতি এ ধরনের আহ্বান একটি বড় ভুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

পেশাগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের তাদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে। কিন্তু উদার শিক্ষা শিক্ষার্থীদের তাদের অবসর সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত করে, যাতে তারা জীবনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দ্বন্দ্বগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকে এবং তাদের কর্ম ও প্রেরণার উৎস সম্পর্কে সচেতন থাকে। ‘দ্য ভ্যালু অব লিবারেল আর্টস এডুকেশন’-এর লেখক জেমস এঙ্গেলের মতে, ‘উদার শিক্ষা একটি শিক্ষিত এবং চিন্তাশীল নাগরিক সমাজ বিনির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহায়তা প্রদান করে।’ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্বে মানবসভ্যতা চোখণ্ডধাঁধানো উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে বস্তুগত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছেছে। মানুষ ছুটছে পুঁজির সর্বোচ্চকরণ এবং বহুমাত্রিক ভোগের পেছনে। কিন্তু মৌলিক মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সমাজ থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, যা সত্যি খুবই উদ্বেগজনক।

মানবিক মূল্যবোধকে পুষ্ট করার জন্য, বহুমাত্রিক চিন্তার ক্ষমতাকে বিকশিত করার জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক দার্শনিকের প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত যে ইতিহাস অধ্যয়নকারী ও ইতিহাসসচেতন একটি নির্দিষ্টসংখ্যক লোক থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা বর্তমানে এসবের বিপরীতে খুব বেশি চাকরি তৈরি করতে পারছি না। ফলে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জন ও একটি চাকরি নিশ্চিত করার জন্য শুধু প্রযুক্তি শিক্ষা দেয়, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব বুদ্ধিমত্তাকে অনেকটা প্রতিস্থাপন করে ফেলেছে। একইসঙ্গে এটি আমাদের নজরদারি পুঁজিবাদ এবং বিগ-ডেটা অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে বলে স্টিফেন হকিং গভীর উদ্বেগ জানিয়ে অনেক আগেই বলে গেছেন।

একসময় বেশির ভাগ মেধাবী ছাত্র ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য এবং অন্যান্য সামাজিক ও মানবিক বিষয় অধ্যয়নের জন্য পছন্দের শীর্ষে রাখত। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা চাকরিমুখী, পেশাগত ও বৃত্তিমূলক বিষয়গুলোকে প্রধান্য দিচ্ছে। পরিণতিতে আমরা এমন কোনো সমাজবিজ্ঞানী পাচ্ছি না, যারা সমাজকে কল্যাণের পথ দেখাতে পারেন। এমন একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পাচ্ছি না, যিনি রাষ্ট্র ও নেতৃত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন। এমন একজন দার্শনিক পাচ্ছি না, যিনি আমাদের বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করতে পারেন এবং জীবনের অর্থ পুনর্নির্ধারণ করতে পারেন। এমন একজন ইতিহাসবিদ পাচ্ছি না, যিনি আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে সাহায্য করবেন, যাতে আমরা সমাজের পাশাপাশি সমগ্র মানবজাতির উন্নতির জন্য নিখুঁতভাবে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

শুধু তাই নয়, আমরা মানবসম্পদের উন্নয়নে তেমন কোনো বিনিয়োগ করছি না, যা মহাবিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, শুধু একজন মানুষ সমগ্র বিশ্বকে ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বোচ্চ স্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামো, পাঠ্যক্রম, পাঠদান পদ্ধতি, পরিবেশ, গবেষণা ও লাইব্রেরি সুবিধার দিক থেকে বিশ্বমানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অবস্থানে একেবারেই নেই। যে মালয়েশিয়া থেকে একসময় শত শত শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়তে আসত, এখন শত শত বাংলাদেশিই সেই মালয়েশিয়ায় পড়তে যাচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে শিক্ষা খাতে সে দেশের সরকারের শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে। আমরা অনেক অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে জনগণের কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছি ইচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে অর্থ ব্যয় করছি না। কারণ কোনো শাসকই চান না জনগণ শিক্ষিত হয়ে তাঁদের চিরস্থায়ী ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে উঠুক। বরং তাদের জন্য দেশের মানুষকে নানাভাবে দাবিয়ে রেখে উন্নয়নের নামে লুটপাট আর অর্থপচারই অনেক সহজ ও লাভজনক। উদার শিক্ষা আমাদের সব পেশা ও শ্রেণির মানুষকে শেখায় কীভাবে মনের কথা বলতে হয় এবং কীভাবে মানবজীবনের অত্যন্ত মূল্যবান মূল্যবোধগুলোর উপাদানগুলোকে জানতে হয় ও বুঝতে হয়।

আমাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয়, বর্ণিল, অর্থবহ ও মানবিক করার জন্য আমাদের অবশ্যই মানবিক ও উদারনৈতিক শিক্ষাকেও এগিয়ে নিতে হবে। আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব যে প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন প্রকৃতপক্ষে মানবিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। সর্বোপরি লিবারেল এডুকেশন আধ্যাত্মিক ও অবস্তুবাদী বিষয়কে জানার মানুষের যে চিরন্তন আগ্রহ, সেটিকেই জাগ্রত করতে এবং একটি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে সহায়তা করতে পারে।

লেখক : কলাম লেখক