জুলাই বিপ্লব : স্বপ্ন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ব্রি. জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মোড় পরিবর্তনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অনেকের কাছে এটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়- এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা, একটি জাতির সম্মিলিত জাগরণ, যা দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন, বিদেশি দখলদারত্ব এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক বিদ্রোহ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই ভারতীয় রাজনৈতিক প্রকৌশলের ছায়ায় এ জাতি বেড়ে উঠেছে। যদিও আনুষ্ঠানিক বর্ণনায় মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের বিজয় হিসাবে তুলে ধরা হয়, বাস্তব ভূরাজনৈতিক সত্য হলো, বাংলাদেশ একটি জনতার বিদ্রোহের পাশাপাশি ভারতের কৌশলগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় আধিপত্য এ রাষ্ট্রের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এসেছে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের শাসনের পতন ছিল রাজনৈতিক অসন্তোষ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের ফল। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা, দুর্ভিক্ষ এবং বিরোধী কণ্ঠরোধ সেই পতনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। তার পতনের পর রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কিছু সময়ের জন্য ভারতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাজনৈতিক চিন্তার পথে যাত্রা শুরু করে। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণার মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ আবারও একটি একনায়কতান্ত্রিক শাসনের আওতায় পড়ে, যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা। এ শাসনকাল ছিল ভোট কারচুপি, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গণতন্ত্রের নামে সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের শাসন। এ সময়ে ভারত বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল দীর্ঘ নীরব সহ্য, তীব্র জনঅসন্তোষ এবং কৌশলগত প্রতিরোধের ফল। এটি কোনো একক দলের বা নেতৃত্বের সৃষ্টি নয়-এটি ছিল একটি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন। যদিও ছাত্র সমন্বয়কারীদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, তা দ্রুত একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর সর্বজনীনতা। এখানে কোনো একক মতবাদ বা দলীয় স্বার্থ নয়, বরং জাতীয় মর্যাদা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রশ্নে এক জাতির ঐক্য গড়ে ওঠে। আমেরিকার কূটনৈতিক চাপ, ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকার ইস্যুতে কার্যকর হস্তক্ষেপও এ বিপ্লবের সফলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়। এক বছর পর, আমরা যদি বিশ্লেষণ করি-তাহলে দেখতে পাই, কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যেমন ঘটেছে, তেমনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন, যা গণতন্ত্রের জন্য কিছুটা হলেও নতুন পথ উন্মুক্ত করেছে। পূর্বে নিষিদ্ধ বা কোণঠাসা অবস্থায় থাকা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। নির্বাচনিব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশের কিছু সংস্কার শুরু হয়েছে। মিডিয়া কিছুটা স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনমত গঠন আবারও সক্রিয় হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, ভারতের নির্ভরতা কমিয়ে আমেরিকা, চীন ও মুসলিম বিশ্বে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। তবে সত্য এটাই যে, জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর মূল চেতনা ও জনগণের উচ্চাশা এখনও পূর্ণ বাস্তব রূপ পায়নি। বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল-একটি মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গঠন। কিন্তু এক বছর পরেও তা অনেকাংশে স্বপ্নের স্তরেই রয়ে গেছে। বিপ্লব-পরবর্তী রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, সমঝোতা ও কৌশলগত ঐক্যের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজ নিজ অবস্থান ও সুবিধা ধরে রাখার প্রতিযোগিতা, নেতৃত্বের অহংবোধ এবং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার প্রবণতাণ্ডসব মিলিয়ে একটি বিপজ্জনক বিভাজন তৈরি হয়েছে, যা জাতীয় অগ্রযাত্রার জন্য চরম হুমকি।

অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার, অদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানির ওপর। মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এরসঙ্গে রয়েছে জ্বালানি সংকট, যা শিল্প, পরিবহণ ও কৃষিখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস করছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো- সাবেক সরকারের অনুগত প্রশাসনিক, গোয়েন্দা ও সামরিক চক্রগুলো আজও সক্রিয়। এদের অনেকেই চুপচাপ থেকে নতুন সরকার ও ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করার জন্য সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এসব চক্রের পেছনে রয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সরাসরি অথবা ছায়াশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। তাদের মূল লক্ষ্য হলো-বাংলাদেশকে আবারও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের অনুগত শক্তিকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এ পরিস্থিতিতে যদি সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সুশীল জনগোষ্ঠী একসঙ্গে সচেতন না হয় এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়-তবে আমরা আবারও ফ্যাসিবাদ ও বিদেশি আধিপত্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত হব। বিপ্লবের আত্মা তখন মৃত হয়ে যাবে এবং জাতি ফিরে যাবে সেই পরাধীনতার গ্লানিকর অধ্যায়ে, যেখানে স্বাধীনতা কেবল কাগজে লেখা থাকবে, বাস্তবে নয়। জুলাই বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। বর্তমান সরকারসহ সব বিপ্লবী অংশগ্রহণকারী গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে একটি জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করে নির্বাচনি ও বিচারিক ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। জুলাই বিপ্লব ছিল এক জাতির স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের রক্তাক্ত জয়গাথা। কিন্তু বিপ্লব কেবল শুরুমাত্র-এখন আসল লড়াই রাষ্ট্র গঠনের, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এবং নতুন মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের। যদি আমরা আবার বিভাজন, দুর্নীতি ও পুরোনো রাজনীতির ধারায় ফিরে যাই-তাহলে এ বিপ্লব কেবল একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে, যার সুফল জনগণ পাবে না। কিন্তু যদি আমরা এ বিপ্লবের চেতনা ও প্রতিশ্রুতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, তাহলে এ বিপ্লব হবে বাংলাদেশের পূর্ণ গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার পুনর্জন্ম।

আসুন আমরা এ বিপ্লবকে ব্যর্থ হতে না দিই। আসুন আমরা ঐক্যের শক্তিকে ধারণ করি, ন্যায় ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে এগিয়ে যাই। একটি সার্বভৌম, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই জুলাই বিপ্লব শুরু হয়েছিল-চলুন সেই স্বপ্নপূরণ করি।

ব্রি. জেনারেল (অব.) এইচআরএম রোকন উদ্দিন : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক