গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্নপূরণ এখনও অনেক দূর
জব্বার আল নাঈম
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাইয়ের তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। উক্ত বছরের একই মাসের ৮ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বছর ঘুরে এলেও দেশের মানুষ কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণ থেকে অনেক দূরে। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে স্বপ্নপূরণের জন্য প্রায় দেড় হাজার আন্দোলনকারী শহিদ হন।
আহত হন কয়েক হাজার। এদের কেউ কেউ এখনও হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এই আত্মত্যাগের কারণ একটাই, তারা মুক্তি চেয়েছিল, মন খুলে কথা বলতে চেয়েছিল, কাজের অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এগুলো ছিল স্বাভাবিক চাওয়া। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের পর চাওয়ার সেই পারদটা আরও বেড়ে যায়। সংবিধান হবে গণতন্ত্রের ভিত, গণতন্ত্র হবে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, যা একটি দেশের জনগণের ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করে, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ায় এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়তা করে। গণতন্ত্রে, জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে আদতে নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান। অথচ গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরও দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারেনি। এটাই গণঅভ্যুত্থানের দুঃখ!
দুঃখ কখনও কখনও ভবিষ্যতের রূপরেখা মেরুকরণের জন্য সুখকর। গণতান্ত্রিক ধারায় কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সংসদে উত্থাপন করতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ফলে এই সরকারের যেকোনো আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ নির্বাচিত সরকারের চেয়ে কিছুটা সহজ। নির্বাচন-পরবর্তী সরকার খুব বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে তা নয়, এই পরিবর্তন সাধিত হয় সাধারণত বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের হাত ধরেই। যদি বিশাল পরিবর্তন সম্ভব হতো, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৬ বছরে সংবিধানতন্ত্রে কাটাকাটির মাধ্যমে অনেক মৌলিক পরিবর্তনই নিয়ে আসত। তা সম্ভব হয়নি! কারণ এখানে লোক-দেখানো হলেও জন-আকাঙ্ক্ষা থাকে, জনসম্পৃক্ততা থাকে। তাই এটা শুধু সম্ভব বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের পক্ষেই।
বাংলাদেশের মানুষকে সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এটাই সম্ভবত এ দেশের সরকারের অহংকার। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ আছে, সেসব দেশের জনগণ তাদের সরকারের দিকে তাকাতে হয় না। আমাদের রয়েছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তের হাজারো সমস্যা। জীবনযাপনে খাদ্যসংকট, অনাহার-অর্ধাহার, অবিচার ও বঞ্চনা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার তো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এতটা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের দেশে প্রত্যাশার পারদ উঁচু হওয়া কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক নয় বলেই আবেগে ভেসে যাই, পরিবর্তনের আশায়। বারবার সাহসিকতার সঙ্গে রক্ত দিয়ে আত্মত্যাগ করতে হয় দেশের মানুষের। তবু পূরণ হয় না জাতির প্রত্যাশা! অথচ মহান স্বাধীনতার পর জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইন্টেরিম সরকারের হাতে পরিবর্তন ও সংস্কারের বিশাল ক্ষমতা এসেছে- এর আগে কখনোই এমনটা ঘটেনি। এখন যদি এই অন্তর্বর্তী সরকার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এবং সংস্কার করতে সক্ষম না হয়, নিশ্চিত করে বলা যায়, এই দেশকে গণতন্ত্রের ধারায় ফেরানো জটিল হয়ে উঠবে। আর তখন দেশের মানুষকে গণতন্ত্র ফেরাতে আবার গণঅভ্যুত্থান অথবা বিপ্লব করা লাগতে পারে।
বিগত ষোলো বছর দেশের মানুষ ও বিরোধী দলগুলো নির্বাচন নিয়ে মাঠে বেশ সোচ্চার ছিল। অথচ সেই দলগুলোরই কয়েকটি এখন নির্বাচন তো চাইছেই না, বরং প্রকাশ্যে বলছে, নির্বাচনের এত তাড়া কিসের! সবাই জানি, নির্বাচন হলো সংঘাত ও বিভেদ হ্রাস, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা, জনগণের ক্ষমতায়ন, আইনের সঠিক প্রয়োগ ও প্রসার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও নিশ্চয়তা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো। আমেরিকার সঙ্গে শেখ হাসিনার দূরত্ব কেন বেড়েছে? কারণ তাদের চাওয়া ছিল গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনব্যবস্থা চূড়ান্ত করা। গণতান্ত্রিক দেশে এই চাওয়া অযৌক্তিক কিংবা অপ্রত্যাশিত নয়।
এমন প্রত্যাশার ভেতর দিয়ে উন্নয়নের ভিত্তি মজবুত হয়। সামনের দিনগুলোতেও সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার দাবির আওয়াজ উঠবে- এটাই স্বাভাবিকতা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব জাস্টিস, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস, মানবিকতা ও মূল্যবোধের অভাব থাকা সত্ত্বেও গত একটা বছর কিছু পজিটিভ দিক ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের, যা সত্যি প্রশংসা করার মতো। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে সক্রিয় হয়েছে, পক্ষ-বিপক্ষ মত তুলে ধরার সঙ্গে মিছিল, মিটিং এবং স্লোগানে অধিকার আদায়ের কথা বলেছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন মতের দলের নেতারা রাষ্ট্রভাবনাকে গতিশীল রাখতে আলোচনার টেবিলে বসেছে। এত দিন যারা সরকারের স্বৈরতন্ত্রের ভয়ে মুখ খুলতে পারছিল না, তারা নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে নিজেদের জাতির সামনে হাজির করতে পেরেছে। আদতে এটাই হলো গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য।
এছাড়া সরকারের বেশ কিছু সাফল্য রয়েছে- ইন্টেরিম সরকারের বড় অর্জন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেষ্টায় জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ স্বাক্ষর, জাতিসংঘ থেকে গণহত্যার রিপোর্ট প্রকাশ। যা গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে- অপরাধীর বিচার দ্রুত শুরু করা সম্ভব। গুম-হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর। আয়নাঘর স্থায়ীভাবে বন্ধ, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালীকরণ, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের প্রতিশ্রুতি, এই লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এই ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য পৃথক কমিশন গঠন।
সংসদীয় ব্যবস্থা আরও কার্যকর, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে আলোচনাও অব্যাহত আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে ভর্তুকি দেবে সরকার। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এবং মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি। ইন্টেরিমের বড় সাফল্য কূটনীতিতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা, যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ বাতিল। ব্যাংক খাতে স্থিরতা আনতে কমিশন গঠন। তবে ইন্টেরিমের সবচেয়ে বড় সফলতা হবে সংস্কার, এরপর নির্বাচন। নির্বাচনের ঘোষণা মানেই যে নির্বাচন কার্যকর বা হচ্ছে- এমনটা নয়। বরং নির্বাচনকে তফসিলমুখী করে ভোটের তারিখ ঘোষণা করতে হবে- তখনই নিশ্চিত হওয়া যাবে। নির্দিষ্ট তারিখে নির্বাচন কার্যকরের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের দরবারে ক্ষমতা হস্তান্তরই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
