পরিবারে ইনসাফভিত্তিক আচরণ কাম্য
এমরান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শান্তির ধর্ম ইসলামে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি জীবনে তথা পরিবারে সুবিচার প্রতিষ্ঠা সবার আগে জরুরি। কেননা পরিবারে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। নু’মান ইবনে বশীর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার তার পিতা তাকে নিয়ে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি আমার এ ছেলেকে একটি গোলাম দান করেছি। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার সব সন্তানকে এমন দান করেছ? পিতা জবাব দিলেন, না। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে এ গোলাম ফেরত নিয়ে নাও।’ এই হাদিস থেকে সহজে অনুমেয় পরিবারের সব সদস্যদের প্রতি সমান আচরণ অভিভাবকের কর্তব্য। এর ব্যতিক্রম হলে পারিবারিক সম্প্রীতি ও বন্ধন একটু একটু করে শিথিল হতে হতে দেখা যাবে, গিট্টু দেওয়ার মতো কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই।
‘ইনসাফ’ মানে সমান বণ্টন। তবে এটি এখন শুধু শাব্দিক বিশ্লেষণের মোড়কে সীমিত নেই, বরং এটি হয়ে উঠেছে ইসলামী শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে হক ও অধিকার সমানভাবে আদায় করার নাম ইনসাফ। পৃথিবীতে মানুষকে চলতে হয় অনেক মানুষকে নিয়ে। তাই ভাবতে হয় সবার অধিকারের কথা। মানুষের সম্মিলিত জীবন যেন সুশৃঙ্খল ও গতিময় হয়, সেজন্যই মহান আল্লাহ ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র যেন ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, সেজন্য ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনের সূরা নাহল-এর ৯০ সংখ্যক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও সদাচারের আদেশ করেছেন।’ একই সূরার ৫৮ সংখ্যক আয়াতে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবে তখন ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করবে।’ জমিজমা, টাকা-পয়সা হলো পারিবারিক বন্ধন শিথিল বা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। বর্তমান সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মহান আল্লাহ পাক প্রদত্ত বিধিবিধান যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। ইসলাম যে সুশৃঙ্খল ও বিধিবদ্ধ নিয়ম তথা ইনসাফভিত্তিক আচরণের কথা বলেছে, অনেক পিতা-মাতাই তার তোয়াক্কা করেন না। কখনও কখনও মা-বাবা বিশেষ কোনো সন্তানের বেলায় পক্ষপাত দেখান। কোনো সন্তানকে বিশেষ স্নেহ করেন। এই বিশেষ স্নেহ বা পক্ষপাতের কারণে অনেক সন্তান সম্পত্তি যতটুকু পাওয়ার কথা তার বেশি পেয়ে থাকে। আবার অনেক মা-বাবা পরিবারের কনিষ্ঠ বা দুর্বল সন্তানকে একটু বেশি জমিজমা দিয়ে থাকেন। এর পেছনে যথেষ্ট ন্যায্য কারণ থাকলেও পরিবারের অপরাপর সদস্যরা তা হাসি মুখে মেনে নেন না। ফলে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ক্রমে ক্রমে বঞ্চিত সন্তানের ক্ষোভ জমতে থাকে বাবা-মায়ের প্রতি, একসময় তা স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। পরিণতিতে পারিবারিক কলহ, অনেক সময় সন্তান কর্তৃক পিতৃহত্যার মতো জঘন্য ঘটনাও সংঘটিত হয়। প্রতিদিন পত্র পত্রিকায় জায়গা-জমি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি, লাঠালাঠি এমনকি খুনাখুনি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। অথচ চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার কথাটা মানুষ বেমালুম ভুলে যায়। এই দুনিয়া আমার স্থায়ী আবাস নয়, স্থায়ী আবাস মাটির নিচে। যেখানে ধনী গরিব, রাজা-বাদশার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। সবার বরাদ্দ সমান। আপনি দুনিয়ায় যতই শক্তিমান হোন মানুষ থেকে যখন আপনার পরিচয় লাশ হয়ে যাবে তখন আপনার দরকার হবে সাড়ে তিন হাত জায়গা। এটুকুই আপনার জন্য বরাদ্দ। আপনার সন্তান-সন্ততির প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও এক ইঞ্চি বেশি আপনার বরাতে জুটবে না। তাই মা-বাবার উচিত সন্তান-সন্ততির মধ্যে ইনসাফভিত্তিক আচরণ করা। অন্যায্য কোনো কিছু ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। তাই পরিবার ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অশান্তির বীজ বপন না করে তা প্রশমনের ব্যবস্থা করা।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
