খাদ্যে ভেজাল : যেন নীরব ঘাতক

জেপুলিয়ন দত্ত জেপু

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান হলো খাদ্য, বায়ু, পানি ও উপযুক্ত পরিবেশ। এরমধ্যে অন্যতম প্রধান উপদান হলো খাদ্য। প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। মূলত খাদ্যের প্রধান উৎস উদ্ভিদ ও প্রাণি জগত। কিন্তু সুস্থ জীবনের জন্য খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন হতে হবে। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্যে ছয়টি উপাদান থাকে। যা সুষম খাদ্য নামে পরিচিত।

মানুষের সুষম খাদ্যের এক মাত্র উৎস হলো উদ্ভিদ ও প্রাণি সম্পদ। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ এ বিশাল খাদ্য সম্ভারের উপর নির্ভরশীল হলেও কিছু মন্দ লোক, ক্রেতা সাধারণকে ঠকাচ্ছে। এরা খাদ্য উৎপাদনে যথোপযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারে নিয়মনীতি না মেনে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে হতাশা। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে দিক নির্দেশনা সংক্রান্ত বিজ্ঞান সম্মত নীতিমালা থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্র তা মানতে চায় না। খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে বিষ মিশাতেও কুণ্ঠিতবোধ করে না।

খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য গ্রহণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যকে জীবানুমুক্ত, দূষণমুক্ত রাখা ও স্বাস্থ্যহানি না হয় মত ব্যবস্থা করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তা শুধু প্রশাসন নয় সচেতন প্রত্যেক নাগরিকেরও দায়িত্ব। যেহেতু খাদ্যের উপর মানুষের বেঁচে থাকা গুরুত্ববহ; সেহেতু খাদ্যে ভেজালরোধে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য সুষম, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য প্রয়োজন। আমিষ, শর্করা, স্নেহ জাতীয় পদার্থ, খনিজ লবন, ভিটামিন ও বিশুদ্ধ পানি এ ছয়টি খাদ্য উপাদান রাসায়নিক পদার্থ। এসব পদার্থের উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন ও সরবরাহ নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে চলে। এক শ্রেণির অতিলোভী দুষ্ট প্রকৃতির ব্যবসায়ী নীতিমালাকে উপেক্ষা করে খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে খাদ্যের মান নিম্নমান ও স্বাস্থ্যঝুঁকি করে বাজার জাত করে চলছে অবিরত। এসব ভেজাল খাদ্য ক্রেতাসাধারণ বুঝতে পারে না বলে প্রতিনিয়ত খেতে থাকে। ফলে এক সময় জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কোন খাদ্যে কোন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে হয় তার সঠিক ও পর্যাপ্ত রাসায়নিক ধারণা না থাকায় অনেক খাদ্য উৎপাদক তথা শিল্প মালিক বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।

দক্ষ রসায়নবিদ নিয়োগ না করে সনাতন পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করা হয় বলে খাদ্যের গুণগত মান ঠিক হয় না। অসাধু শিল্পমালিক অতি মুনাফার লোভে অপরাধ করেও আইনের ফাঁক দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নীতিবহির্ভূতভাবে খাদ্যে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালডিহাইড, পাটাশ ব্যবহার করে খাদ্যকে খাওয়ার অনুপযোগী করে বাজারে বিক্রি করে। এতে ক্রেতা সাধারণ না জেনে এসব খাদ্য ক্রয় করে খাচ্ছে আর বিভিন্ন কঠিন ও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশের প্রত্যেক জায়গায় সব রকম খাদ্য উৎপন্ন হয় না। গ্রামে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, ফল ও শস্য উৎপন্ন করা হয়। এসব শাক-সবজি ও ফলে পোকামাকড় থেকে রক্ষার জন্য ছিটানো হয় বিষ। যা ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়াও প্রাণিজ আমিষের উৎস মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম। উদ্ভিদ ও প্রাণিজ খাদ্যের সিংহ ভাগ গ্রামীণজনপদে উৎপন্ন হয়। শহর অঞ্চলের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগের দূরত্ব বেশি। তাই গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা এসব উৎপন্ন খাদ্য যথানিয়মে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারলে খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা খাদ্য পচনশীল হলেও খাদ্য সংরক্ষক দিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ সব খাদ্য সংরক্ষণের বিষয় মূলত নির্ভর করে রাসায়নিক ও প্রযুক্তি জ্ঞানের উপর। কোন খাদ্যে কোন ধরনের খাদ্য সংরক্ষক কতটুকু দিতে হয় তা রাসায়নিক বিশ্লেষণ ছাড়া নির্ধারণ সম্ভব নয়। খাদ্যকে যথা নিয়মে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে সহজলভ্য করা যায়। মাছ, মাংস, শাক-সবজি ও ফল সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন যা মিথানলের ৩০-৪০% জলীয় দ্রবণ। এটিও মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকারক বলে জানা যায়।

বর্তমানে ফলের বাজারে কাঁচা ফলকে আকর্ষণীয় পাকা রং করতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেটের মত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছে ফল ব্যবসায়ীরা। যা মারাত্মক অপরাধ বলে গণ্য। এসব অসাধু ফল ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে ভোক্তার অধিকারও নিশ্চিত করা যাবে। এ ক্ষেত্রে জন সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া খাদ্য ব্যবসায়ীদের রাসায়নিক জ্ঞান না থাকায় আজকে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। খাদ্য সংরক্ষণে দক্ষ রাসয়নবিদ তৈরি করার জন্য বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ের সংশ্লিষ্ট পাঠের উপরও জোর দিতে হবে। যেহেতু খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং এর মাধ্যমে প্রশাসক যদি আইনের কঠোরতা প্রয়োগ করতে পারে তাহলে খাদ্যে ভেজাল মেশানো অনেকটা রক্ষা করা যাবে।

আইনের প্রয়োগ যদি শিথিল হয় তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীরা পার পাবে। ফলে আগামী দিনে মানুষের সুস্থ জীবন নিয়ে বাস করা ভয়াবহ হবে। একদিকে ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ দিন দিন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে সুচিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে ভিড় করছে। অন্যদিকে যারা আর্থিক সংকটের কারণে বিদেশে চিকিৎসা করতে যেতে পারছে না তারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভিড় জমাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আবার এক শ্রেণির ঔষুধ শিল্প মালিক জীবন রক্ষাকারী ঔষুধে ভেজাল মিশিয়ে লুফে নিচ্ছে অর্থ। অতএব ভেজাল খাদ্য একটি নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।