সৃজনশীলতার ডানা মেলুক আমাদের শিশুরা
নাহিদা ইসলাম
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দুই মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন ভোরে স্কুলে যেতে হয় আমাকে। সকালের নাস্তা সেরেই স্কুলের দিকে যাত্রা করে তারা। হেলে দুলে আর নাচতে নাচতে স্কুলের দিকে ছুটে চলে আমার কচি দুটি প্রাণ। আবার ছুটি শেষে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয় তাদের। অথচ কয়েক মাস আগেও যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তখন ভারি একটি ব্যাগ কাঁধে স্কুলের পথে যেতে হতো তাদের। গদবাঁধা মুখস্ত পড়াও শিখে যেতে হতো সোনাপাখিদের। ব্যাগের ভারে অনেকটা ন্যুয়ে পড়ার মতো যেন পরিস্থিতি। এখন শিশুরা স্কুলে পড়ে, খেলে বেড়ে উঠছে সৃজনশীলতায়।
মূলকথা হচ্ছে- শিশু হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তাই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ধরন ও মান একটি দেশের উন্নয়ন যাত্রাকে অনেকাংশে নির্ধারণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পরিবেশ এখনও অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য চাপের কারণ। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয় আনন্দ, খেলাধুলা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। দুই দেশের এই বৈপরীত্য আমাদের জন্য শেখার অনেক কিছু রয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের পড়ানো হয় মূলত কার্যকরি দক্ষতা ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষার মাধ্যমে। এখানে বই পড়ানো হয় ঠিকই; কিন্তু বই কখনোই হয়ে ওঠে না চাপের বোঝা। ছোট ক্লাসগুলোতে শিক্ষার্থীরা দিন শুরু করে গান, গল্প, আঁকাআঁকি, দলীয় আলোচনা কিংবা খেলার মাধ্যমে। শিক্ষকরা শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করেন, নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেন। পাঠ্যসূচি এমনভাবে সাজানো হয় যাতে শিশুদের কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। স্কুলে বইয়ের বোঝা নেওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই।
বিজ্ঞান, গণিত কিংবা ইংরেজির মতো বিষয়গুলো শেখানো হয় খেলাধুলা ও ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে। এমনকি বিদ্যালয়ের আঙিনা ও কমিউনিটি পার্ককে শিক্ষার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে শিশুরা শেখে আনন্দের মাধ্যমে, ভয় বা চাপের মাধ্যমে নয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন। এখানে শিশুরা স্কুলে আসে ভারি বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। পাঁচণ্ডছয় বছর বয়স থেকেই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় একাধিক বিষয়, অসংখ্য অধ্যায় এবং প্রতিদিনের হোমওয়ার্কের চাপ। শিক্ষকরা অনেক সময় পাঠ্যবই শেষ করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন, যেখানে শিশুর মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা কিংবা আনন্দের জায়গা কমে যায়। ফলে পড়াশোনাকে শিশুরা আনন্দ নয়, বরং একধরনের ভয়ের বিষয় হিসেবে দেখে। এ কারণে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার এখনও উদ্বেগজনক।
দেখা যায়, আমাদের সমাজে যেসব সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা ধনী পরিবারের মানুষ আছেন, তাদের সন্তানরা পড়াশোনার জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই বিদেশমুখী হয়। তারা নিজের সন্তানের জন্য যুক্তরাজ্য বা অন্য উন্নত দেশের শিশুবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা বেছে নিলেও, দেশের সাধারণ শিশুদের জন্য সেই ব্যবস্থার প্রয়োগ চায় না। বরং তারা বাংলাদেশের এই গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর কারিকুলামকেই জিইয়ে রাখে। এর ফলে ধনী-গরিবের মাঝে একটি অপ্রতিরোধ্য শিক্ষা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। অথচ একটি জাতির অগ্রগতিনির্ভর করে তখনই, যখন প্রত্যেক শিশু সমান সুযোগে সৃজনশীল ও আনন্দমুখর শিক্ষার পরিবেশ পায়। যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের প্রতিদিনের শিক্ষাজীবন সাজানো হয়, অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং শিশুবান্ধবভাবে। সাধারণত সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হয় এবং বিকেল ৩টার দিকে শেষ হয়। দিনের শুরুতে থাকে অ্যাসেম্বি বা মর্নিং সার্কেল, যেখানে শিশুরা গান গায়, ছোট গল্প শোনে, কিংবা দিনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। এরপর মূলত ২-৩টি শিক্ষণ সেশন থাকে- যেমন ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান। প্রতিটি সেশনের মাঝে থাকে ১৫-২০ মিনিটের ব্রেক টাইম, যেখানে শিশুরা মাঠে খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়।
দুপুরে প্রায় ১ ঘণ্টার লান্স ব্রেক দেওয়া হয়, যেখানে শুধু খাওয়া নয়, বরং খেলাধুলা ও সামাজিক মেলামেশাও থাকে। বিকেলের ক্লাসগুলোতে থাকে সৃজনশীল কার্যক্রম চিত্রাঙ্কন, সংগীত, নাটক, শারীরিক শিক্ষা বা দলীয় প্রজেক্ট। অনেক স্কুলে সপ্তাহে অন্তত একদিন শিশুদের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে তারা নিজের পছন্দের বই পড়ে। দিনের শেষভাগে থাকে রিফ্লেকশন টাইম, যেখানে শিশুরা সারাদিন কী শিখল তা আলোচনা করে এবং শিক্ষক তাদের উৎসাহ দেন। এই রুটিনের মাধ্যমে শিশুরা একদিকে পড়াশোনায় অগ্রসর হয়, অন্যদিকে খেলা, শিল্পকলা, সামাজিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসও গড়ে তোলে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদিনের ক্লাস শেষে তারা শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে না, বরং পরের দিন আবার নতুন কিছু শেখার জন্য উৎসাহিত থাকে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষাতত্ত্ব বলছে, শৈশবকাল হলো খেলার মাধ্যমে শেখার সময়। শিশুরা এ বয়সে যা দেখে, স্পর্শ করে, পরীক্ষা করে- সেখান থেকেই তারা সবচেয়ে ভালো শেখে। যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়। শিশুদের শেখানো হয় ‘হ্যান্ডস-অন লার্নিং’ বা ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা’। এর মাধ্যমে যেখানে তারা নিজের হাতে কিছু তৈরি করে, সমস্যা সমাধান করে এবং দলীয়ভাবে কাজ করতে শেখে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাদান এখনো মূলত ‘মুখস্থনির্ভর’, যেখানে পরীক্ষায় ভালো করার জন্য শিশুদের চাপ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হলে কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, শিশুদের বইয়ের চাপ কমাতে হবে। একবারে সব বিষয় না পড়ে বরং বিষয়ভিত্তিক থিম বা প্রকল্পনির্ভর শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। যেমন- ‘আমার গ্রাম’, ‘প্রকৃতি’, ‘আমাদের পরিবার’ ইত্যাদি থিম ধরে বিজ্ঞান, গণিত, বাংলা ও সমাজবিজ্ঞানকে একসঙ্গে শেখানো যায়। এতে একইসঙ্গে অনেক বিষয় শেখা সম্ভব হবে, আবার বইয়ের সংখ্যাও কমবে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ে খেলাধুলা, গল্প বলা, আঁকাআঁকি, দলীয় আলোচনা এবং ব্যবহারিক কাজের সময় বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ধরন পরিবর্তন করতে হবে। একজন শিক্ষক শুধু বই শেষ করানোর দায়িত্বে নয়, বরং শিশুর কৌতূহল জাগ্রত করার মূল চালিকাশক্তি হওয়া উচিত। এজন্য শিক্ষককে শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
যুক্তরাজ্যে যেমন শিক্ষকরা শিশুদের নাম ধরে ডাকে, তাদের প্রশ্ন শোনে এবং প্রতিটি শিশুর শেখার ধরন অনুযায়ী শিক্ষা দেয়। আমাদের দেশেও এই চর্চাজরুরি। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা যদি শিশুদের বইয়ের ভারমুক্ত করে আনন্দমুখর ও সৃজনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, তবে তবেই আমরা ভবিষ্যতের জন্য আলোকিত নাগরিক গড়ে তুলতে পারব। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে- শিশুদের জন্য শিক্ষা মানে শুধু বই নয়, বরং জীবনকে জানা, বুঝা ও ভালোবাসা। তাই এখনই সময়, আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে বইয়ের বোঝা থেকে মুক্ত করে শৈশবের প্রকৃত আনন্দ ফিরিয়ে আনি।
লেখক : সমাজকর্মী, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
