দুর্গম ও চরাঞ্চলে শিশুদের পোলিও টিকা নিশ্চিত করতে হবে
মো. শামীম মিয়া
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি জাতির ভবিষ্যৎনির্ভর করে তার শিশুর নিরাপদ শৈশব ও সুস্থ বিকাশের ওপর। বাংলাদেশ যে ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখার সংগ্রাম শেষ হয়নি।
কারণ বিশ্বে এখনও পোলিও ভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হয়নি এবং সামান্য অসতর্কতা আমাদের শিশুদের আবারও ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
পোলিও : ভয়ংকর এক ভাইরাসজনিত রোগ : পোলিও বা পোলিওমাইলাইটিস একটি সংক্রামক ভাইরাস, যা প্রধানত পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের আক্রমণ করে। ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পর স্নায়ুতন্ত্র ও মেরুদণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই শিশুকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। একসময় প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ শিশু পোলিওতে আক্রান্ত হতো। ১৯৮৮ সালে বৈশ্বিকভাবে প্রায় ৩.৫ লাখ শিশু পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক টিকাদান কর্মসূচির ফলে ২০২৩ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কমে মাত্র কয়েকশ’তে নেমে এসেছে। তবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে এখনও নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মানে দাঁড়ায়, ভাইরাসটি পুরোপুরি বিলীন হয়নি- কোথাও না কোথাও তা লুকিয়ে আছে এবং বৈশ্বিক ভ্রমণ বা সীমান্ত অতিক্রমের কারণে সহজেই অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের অর্জন ও চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৯ সালে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি (EPI) চালু করে। পরে ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয় জাতীয় টিকাদান দিবস (NID), যেখানে প্রতিটি শিশুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করে টিকা খাওয়ানো হয়। UNICEF, WHO এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় এই কার্যক্রম এক ঐতিহাসিক সাফল্যে পৌঁছায়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পোলিওমুক্ত দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তবে চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে।
UNICEF -এর ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী- বাংলাদেশে পূর্ণ টিকাকরণের হার বর্তমানে প্রায় ৮১.৬ শতাংশ। এখনও প্রায় ৪ লাখ শিশু আংশিক টিকা পেয়েছে এবং প্রায় ৭০ হাজার শিশু একবারও কোনো টিকা পায়নি। শহরে পূর্ণ টিকা প্রাপ্তির হার ৭৯ শতাংশ, আর গ্রামে ৮৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, দুর্গম ও চরাঞ্চল, পাহাড়ি গ্রাম এবং শহরের বস্তিতে বসবাসকারী অনেক শিশুই এখনও টিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে নদীভাঙন, ভৌগোলিক অপ্রবেশ যোগ্যতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি এ অঞ্চলে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন টিকা নিশ্চিত করা জরুরি? একটি শিশু যদি পোলিওতে আক্রান্ত হয়, তবে শুধু সে নয়, পুরো পরিবার ও সমাজ আজীবন এর বোঝা বহন করে। স্থায়ী পঙ্গুত্ব শিশুর শিক্ষা, কর্মজীবন ও সামাজিক মর্যাদার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। রাষ্ট্রের জন্যও এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক চাপ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পোলিও আক্রান্ত শিশুর আজীবন চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যয় কয়েক লাখ টাকার বেশি হতে পারে। অথচ মাত্র দুই ফোঁটা ওরাল ভ্যাকসিন শিশুদের আজীবন সুরক্ষা দিতে পারে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG-3) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে শতভাগ টিকাদান নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
গুজব ও অসচেতনতার বাধা : বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে টিকাদান কর্মসূচির পথে গুজব ও ভুল ধারণা অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারও কারও বিশ্বাস, টিকা নিলে শিশুর শরীরে ক্ষতি হবে বা ভবিষ্যতে সন্তান জন্মদানে সমস্যা হবে। এসব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ধারণা। অথচ এই ধরনের গুজবের কারণে অনেক অভিভাবক টিকা খাওয়াতে দ্বিধা করেন। তাই গণমাধ্যম, ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া জরুরি।
করণীয় : ১. সচেতনতা বৃদ্ধি : গ্রাম-শহর সর্বত্র প্রচারণা চালাতে হবে- ‘মাত্র দুই ফোঁটা, আজীবন সুরক্ষা।’ ২. দুর্গম এলাকায় বাড়তি নজরদারি : চরাঞ্চল, পাহাড়ি গ্রাম বা দুর্গম দ্বীপগুলোতে বিশেষ স্বাস্থ্যকর্মী দল পাঠাতে হবে। ৩. ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার : প্রতিটি ইউনিয়নে কতজন শিশু টিকা পেয়েছে এবং কতজন বাকি আছে- এমন একটি নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। ৪. ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সম্পৃক্ত করা : মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা স্থানীয় সভার মাধ্যমে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। ৫. মা-বাবার সচেতনতা: শিশুদের টিকা খাওয়ানোর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মা-বাবার। তাদের সক্রিয় হতে হবে।
বাংলাদেশ একসময় পোলিও আক্রান্ত শিশুদের কান্নায় ভারাক্রান্ত ছিল। আজ আমরা অনেকটা এগিয়ে গেছি, কিন্তু এখনও নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় আসেনি। আমাদের সামনে লক্ষ্য একটাই- শতভাগ শিশুকে পোলিও টিকার আওতায় আনা। এটি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। কারণ একটি শিশু যদি টিকা থেকে বাদ পড়ে, তবে পুরো জাতি ঝুঁকির মুখে পড়ে। শিশুদের পোলিও টিকা নিশ্চিত করা মানে তাদের জীবন, স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করা। আর এটিই একটি উন্নত, শক্তিশালী ও সুস্থ বাংলাদেশ গঠনের প্রথম শর্ত।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা
