নজরুলের চিন্তা-চেতনা ও আমাদের দায়িত্ব
আফতাব চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গেল শতকের নব জাগরণের যুগের উজ্জ্বল প্রতিনিধি হলেন- কাজী নজরুল ইসলাম। জন্মলগ্ন থেকে কবিকে নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। যার কারণস্বরূপ বাল্যকালে কবির নাম হয় ‘দুখু মিয়া’। অষ্টম বর্ষীয় কবিকে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে রেখে তার পিতা ফকির আহমেদ লোকান্তরে যান। কাটোয়া জেলার মাথুরন গ্রামের ‘নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউট’ এ কবির পড়াশোনা শুরু হয়; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কবির ভাগ্যে বেশি দিন জুটেনি। তথাপি কবি নজরুল কিছুদিন তৎকালীন বাংলার এক বিখ্যাত কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়ে আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মনে পড়ে একটু দরদ ভরা আন্তরিক মূল্যায়নের জন্য কবির সে আকুতি- ‘যেদিন আমি দূর তারার দেশে চলে যাব... তারপর হয়তো বা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা, কত কবিতা হয়তো বেরুবে আমার নামে। দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা। এ অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না।’
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কেমন করে হারিয়ে গেল, কেন হারিয়ে গেল সেদিনের সে উদ্দাম, উজ্জ্বল প্রাণবন্ত সৃষ্টির যুগ? বন্ধ্যাত্ব, অনীহা, নিস্পৃহতা, স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতার জোয়ারে কেন আজ দেশের মানুষ? যুবশক্তি ভুলে যেতে বসেছে সেদিনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে, প্রাণের সকল সম্পদ যেন আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে, ভোগবাদী অবক্ষয়ী সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য এবং লাগামছাড়া লোভ-লালসায়। কেনই বা আজকের যুবসমাজ অর্থাৎ দেশের যারা মেরুদণ্ড তারা ক্রমাগত অপসংস্কৃতি, লোভ-লালসা প্রভৃতি বিনষ্টকারী শক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে?
এ জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে আমরা কোনোমতে আজ তার জন্মদিনে কোনো শ্রদ্ধার্ঘ দিতে পারব না। আবেগ ভরা দুটো কথা, কিছু গান, কিছু আড়ম্বর, লোক দেখানো চাকচিক্য-এ সমস্ত হবে। নজরুলের ভাষায়- ‘অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিন।’ ঠিক যদি আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং সততার সঙ্গে নজরুলের উদ্দেশ্যে যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই তাহলে প্রয়োজন যথার্থভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে, এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিন্তাজগতের তথা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে তার অবদানকে সঠিকভাবে নিরূপণ করা।
তাহলে আমরা স্থির করতে পারব আমাদের করণীয় কি কাজ, অতীত আমাদের জন্য কি রেখে গেছে। এ কর্তব্য আমরা শুধু আবেগকে সম্বল করে নিছক সদিচ্ছা নিয়ে করে উঠতে পারব না।
নজরুল জন্মেছিলেন পরাধীন ভারতে। এদেশ তখন একদিকে ধর্মীয় চিন্তা এবং অনুশাসনে পরিচালিত সামন্ততন্ত্র, অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ- এ দুই এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে, নবজাগরণের বিকাশ হচ্ছে, মানবতাবাদী চিন্তা সমাজে দানা বাঁধছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রথম যুগের বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন; সমস্ত রকম অতি প্রাকৃত সত্তাকে অস্বীকার করে পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্দীপ্ত, প্রগতির কেতনবাহী; কিন্তু সংকটের পথে ক্ষয়িষ্ণু জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে; একচেটিয়া পুঁজিবাদের রূপ নিয়েছে; সংকট এড়াতে উপনিবেশ গড়ে তুলেছে; সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণী ভুলে গিয়ে অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব হরণ করেছে সামন্ততন্ত্র তথা আধ্যাত্মবাদী চিন্তা-ভাবনার বিরুদ্ধে পার্থিব মানবতাবাদী আপস সংগ্রামকে পরিত্যাগ করে তার সঙ্গে আপস করে চলেছে ফলে আপসমুখী জরাগ্রস্ত মানবতাবাদী চিন্তাদর্শ গড়ে তুলে তাকেই আশ্রয় করছে; জাত-পাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে সাম্য-মৈত্রীর বদলে এদের অবলম্বন করে বিভেদকে নতুন করে উস্কে দিয়েছে; জীবনবিমুখতা, পলায়নী-মনোবৃত্তি, সন্দেহবাদের মতো ক্লীব, হতাশাব্যঞ্জক চিন্তা ভাবনার চর্চা করিয়েছে অন্যদিকে এ মরণোন্মুখ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে মানবসভ্যতার নবমতম দর্শন মার্কসবাদণ্ডলেনিনবাদ।
এ দর্শনচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের দিকে শুরু হয়েছে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এমনকি ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যার শাসনক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সর্বহারা শ্রেণী। নজরুলকে বুঝতে হলে ইতিহাসের এ গতিপথকে ভুলে গেলে কোনোমতে হবে না। তাহলে কারণ বোঝা যাবে না, ভারতবর্ষের সংস্কৃতির বিকাশের কোন পটভূমিতে ‘নজরুল’ হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় এদেশে নবজাগরণের সূচনা করেন। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার মধ্যে পার্থিব মানবতাবাদ গড়ে ওঠার প্রবণতা। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘সাংখ্য বেদান্ত ভ্রান্ত দর্শন’ পরিবর্তে পড়তে হবে ইংরেজি ও আধুনিক বিজ্ঞান। তারপর একটা বিরাট সময় ধরে পার্থিব চিন্তার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, পার্থিব ধারাটি যেন প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা গেল মানবতাবাদ আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে মিশে আপস করে বিকশিত হতে চাইছে।
নবজাগরণের শেষ ভাগে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের পার্থিব মানবতাবাদী ধারার ধারাবাহিকতায় কাব্য জগতে নজরুলের আবির্ভাব। এদেশের নবজাগরণের কাব্য ধারায় নজরুল হচ্ছেন আপসহীন ধারার সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবি। নজরুল ছিলেন একজন সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ তার অন্তরের প্রেরণালব্ধ ও নিজস্ব কল্পনার রঙ্গে রঙিন। গভীর ঘনিষ্ঠ মানবতাবোধ হচ্ছে এ সাম্যবাদের ভিত্তি। নজরুলের কবিতা কখনও মানুষকে অস্বীকার করে না। সেখানে মানুষের গুরুত্ব সর্বাধিক। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সকল দায়বদ্ধতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের তিনি বন্ধু ছিলেন। তথাকথিত কোনো দলভুক্ত না হয়ে তিনি মানবতাবাদ ও সাম্যবাদী চেতনায় ছিলেন উন্মুখ। জাতি, ধর্মের ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে কবি তার নিজ সমাজের কাছে বহু সমালোচিত হয়েছিলেন এবং জীবনে নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। তার সে সমস্ত রক্ত লেখনীগুলোতে তিনি সব সমস্ত নিপীড়িত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা ধরনের দুঃখ, যন্ত্রণাকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন।
শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল তার কবিতায়। এজন্য কবিকে অনেকবার এজন্য কবিকে অনেকবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। তথাপি কবি কখনও কারও ভয়ে তার কাব্য আন্দোলন বন্ধ করেননি। সাম্যবাদী কবি নজরুলের জীবনধারাতে এক সমুচ্চ মানবতাবাদের দ্বিধাহীন, আপসহীন স্রোতের সঙ্গে অন্যায়ের বিরদ্ধে চিরসংগ্রাম স্রোত মিলিত হয়েছিল। সকল প্রকার কুসংস্কারহীন বিশ্বব্যাপী মহান ঐক্যের চেতনা তাকে জাতি মিলন, ধর্ম মিলন, সাংস্কৃতিক মিলনের প্রতীক করে নিয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে আমরা নজরুলকে শুধুমাত্র কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে চিনি। কিন্তু তার সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান ছাড়াও ছিল সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার জগতে চরম বিদ্রোহ এবং সাম্যবাদীতার অনন্য নজির। সরকারবিরোধী সাংবাদিকতার জন্য তাকে বহুবার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলের শিকার হতে হয়েছিল।
ইংরেজ ঔপনিবেশ পরাধীন ভারতে তখন রুশ বিপ্লবের কথা সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শ উচ্চারণ করা কঠিন কাজ ছিল। সে কঠিন সময়ে শ্রমিক কৃষক সংগঠনের নেতা কাকা মুজাফফর আহমদের সুরে সুর মিলিয়ে সাম্যবাদ তথা সমাজবাদের জোরদার আওয়াজ তুলেছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। ১৯২৫ সালে সাম্যবাদী কবি নজরুল সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। লাঙলের প্রথম সংখ্যাতে নজরুলের প্রতিবেদন ছাড়াও ‘সাম্যবাদী’ কবিতা ছিল। এ সংখ্যার লাঙ্গল শীর্ষক সম্পাদকীয়তে নজরুল লিখেছিলেন, ‘এ পাষাণ শহরেই আমরা সোনা ফলাতে চাই।’ এ পত্রিকার মাধ্যমে বাংলায় ধনি, জমিদার, জোতদার নিধনের সংগ্রাম ঘোষিত হয়। ফলে প্রথম সংখ্যা বেরোনোর পর লাঙ্গল পত্রিকা জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে যায়। পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘কার্ল মার্কস তার অর্থনীতি এবং রাজনীতি’ ‘লেনিন ও সোভিয়েত রাশিয়া’ শীর্ষক দেবব্রত বসুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দেশবাসীকে গণআন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লেখা লাঙ্গলে প্রকাশ করতে থাকেন।
বিপ্লব হচ্ছে এক আমূল পরিবর্তন। নবজাগরণের যুগের সংস্কৃতি বিপ্লবের পতাকা যারা বহন করেছিলেন নজরুল ছিলেন তাদের একজন। এর দৃষ্টান্ত আমরা কবির লেখা ও জীবনাদর্শের মধ্যে পাই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি; তলোয়ার লুকিয়ে তার রূপার খাপের ঝকমকানিটাকে দেখাইনি এটা আমার অপরাধ! এজন্যই তো আমি বিদ্রোহী। আমি এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি সমাজের সকল কিছু কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙ্গিয়ে গেছি এর দরকার ছিল মনে করে।’ নতুন করে গড়তে চাই বলে তো ভাঙ্গি- শুধু ভাঙ্গার জন্য ভাঙ্গার গান আমরা নয়।’ (অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁকে লেখা চিঠি)। ঠিক অনুরূপভাবে মানবতাবাদের সুরকে প্রতিধ্বনিত করে তিনি বলেছিলেন: ‘সমাজ, রাজা, দেবতা কাউকে মেনো না। নিজের মনের শাসন মেনে চল। যা মান না, যা বোঝ না, তাকে স্বীকার করো না, মাথা উঁচু করে সত্যকে স্বীকার করো।’ তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়, নেই কিরে কেউ সত্যসাধক বুক খোলে আজ দাঁড়ায়?’ তিনি সদম্ভে ঘোষণা করলেন, ‘আমি সত্য প্রকাশের যন্ত্র, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি কারো তোষামোদ করিনি।’
শুধু কথার কথাই মাত্র নয়, তার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন ‘ধূমকেতু’র বিরুদ্ধে মামলায়, আদালতের জবানবন্দিতে। প্রমাণ করেছেন সত্য কথনের, অপরাধে, প্রাচীনকে ভেঙে নতুনকে আবাহনের অপরাধে তার উপর শাসকদের খড়গ নেমে এলেও সংকল্প থেকে তাকে বিচ্যুতি করা যায়নি। তাই কবি দৃপ্তকণ্ঠে প্রশ্ন করেছেন, ‘জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো এ কি কেউ সহ্য করতে পারে?’ বিদ্রোহী কবির এ প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে আমরা যারা সমাজে মানুষ বলে পরিচিত, তাদের উচিত নয় কি, পুঁজিপতি শাসকযন্ত্রের উপর একযোগে সোচ্চার হয়ে তীব্র গণসংগ্রাম গড়ে তোলা? তবে তো হবে বিদ্রোহী কবির সে সমস্ত প্রশ্নের মোক্ষম জবাব।
মনুষ্যত্ব ও মর্যাদাহীন জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার চেয়ে যদি অন্য কোন দুঃখ বড় হয়ে দেখা দেয় তাহলে একজন মানুষের পরিচয় কি রইল? নজরুল লিখেছেন- ‘বিংশ-শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এর অভিযানে সেনাদলের তুর্যবাদকের একজন আমি। আমি জানি এ পদযাত্রায় পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল-ফণা ভুজঙ্গ, প্রখর দর্শন শার্দুল, পশুরাজের ভ্রূকুটি এবং তাদের নখর দংশনের ক্ষত আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু এ আমার পথ, এ আমার গতি।’
দেশের যুব শক্তিকে আহ্বান করে তিনি বলেন, ‘বাংলার ছেলে তুমি, বলো আমি সব দেব, আমি সব নেবো-পারবে কি? যখন অগ্রসর হতে হতে একটি করে সেনাপতি আহত হয়ে পড়বে; তখন সে শ্মশানে-কবরস্থানে নিজ স্থান অধিকার করে থাকতে পারবে কি? শত্রুর সেনা যখন তোমার ঘরে রক্তস্রোত বয়ে দেবে, তখন তোমার চক্ষু পশ্চাতে ফিরবে না তো? এ অন্ধকারে তোমরা চলতে পারবে তো? মাতার ক্রন্দন প্রিয়ার ব্যাকুলতা দলিত করে একা অন্ধকারে এপথ চলতে পারবে তো?’ তদানীন্তন ভারতবর্ষের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর শোষণ, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সামন্ত সমাজে, অন্য সব কিছুর সঙ্গে এ ছিল তার এক কলঙ্কজনক বৈশিষ্ট; তাই নবজাগরণে ব্যক্তি মুক্তির পাশাপাশি এসেছিল নারী মুক্তির আহ্বান।
আপসহীন মানবতাবাদী নজরুল তখন মুক্তকণ্ঠে জানালেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ যে স্বাধীনতা আন্দোলন সেদিন গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলে তাতে যে প্রকৃত গণমুক্তি অর্জিত হবে না, বিপুল সংখ্যক দরিদ্র সাধারণ মানুষের জীবনের দুর্দশামোচন হবে না, এ জ্বলন্ত সত্যখানি নজরুলের চিন্তায় তখন এসেছিল; তাই তিনি ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় বিদ্রূপ ভরা কথায় স্পষ্টভাবে বলেছেন- ‘আমরা তো জানি স্বরাজ আনিতে/পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস/কত শত কোটি ক্ষুদিত শিশুর ক্ষুধা নিংরিয়া কাড়িয়া গ্রাস/এলো কোটি টাকা এলো না স্বরাজ/টাকা দিতে নারে ভুখারী সমাজ।/মার বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়/মোরা বলি বাঘ, খাও হে ঘাস।’
সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটিয়ে এদেশের পুঁজিবাদের বিকাশকে নিরঙ্কুশ করার জন্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের উগ্রবাসনায়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঝান্ডাটিকে তখন অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তাই ভারতীয় জাতি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এমনকি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বল হয়ে গেল; এক জাতি, এক প্রাণ এর আহ্বান থাকা সত্ত্বেও জাত-পাত-ধর্ম-ভাষা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ভেদাভেদ থেকে গেল, ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আপসের ফলে একদিকে হিন্দু ধর্মীয় পুনরুত্থানে হিন্দুধর্ম প্রভাবিত জাতীয়তাবাদের ঝোঁক দেখা দিল অন্যদিকে গড়ে উঠল মুসলিম জাতীয়তাবাদ। ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করে, হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে কাজে লাগিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে টিকিয়ে রাখল।
সংবেদনশীল, আবেগমুখর কবি তখন চুপ করে থাকতে পারলেন না। গভীর ব্যথা-বেদনা নিয়ে তিনি এ ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন এবং ভেদাভেদকে দূর করার জন্য তিনি সংকল্প নিয়ে গেয়ে উঠলেন, ‘মোরা একই বৃত্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তার প্রাণ।’
শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী শাসকবর্গের বিরুদ্ধে জোরাল প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হবার দরুন তাকে বার বার কারাবরণ করতে হয়েছিল। তিনি কারাবরণ করেও থমকে থাকেননি, তিনি জেলে বসে গর্জে উঠছিলেন, ‘কারা ঐ লৌহ কপাট/ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/রক্ত জমাট শিকল পূজার/পাষাণ বেদী।’
নজরুল শুধু কাব্য রচনা, সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের ময়দানে যোগ দিলেন। হেমন্ত সরকারের মতো চাষি আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন তখন শুরু হয়েছিল সে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন চাষি সংগঠন গড়ে তুলতে। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে চারণের রূপে পথে পথে ঘুরেছেন- গ্রামের চাষি সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করতে। আমরা অনেকে জানি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা যুগে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের উদাত্ত গান বিভিন্ন আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছিল। চারণ নজরুল বহিরঙ্গে ছিলেন সে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক; কিন্তু এক অর্থে নজরুল ইতিহাসের গতিপথে সেখানে থেমে থাকেননি। তাই চারণ নজরুলের গানে এসে লেগেছিল, ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি চাষি-মজুর-মধ্যবিত্তের শোষণ মুক্তির আকাঙ্ক্ষার নতুন সুর। কবিকে অবলম্বন করে নতুন করে শুরু করতে হবে আমাদের পথচলা।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
