প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৩ আগস্ট, ২০২৫
বিগত ১৫ বছরে পূর্ববর্তী সরকার রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। বাণিজ্য সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রণীত বাণিজ্য সংগঠন বিধি-১৯৯৪ ও বাণিজ্য সংগঠন আইন-২০২২-কে শাসকগোষ্ঠীর দোসররা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছামতো কাঁটাছেড়া করে পছন্দের প্রার্থীদের সিলেকশন করে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতেন, সাধারণ ভোটারদের ভোট দিয়ে সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন করার অধিকার ছিল না।
ছাত্র-জনতার মনসুন রেভোলুশন (বর্ষা বিপ্লব)-এর পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দীর্ঘদিনের বঞ্চিত ও বৈষম্যের স্বীকার ব্যবসায়ীরা ফেডারেশন ভবনের সামনে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের কারণে সরকার বিগত পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন। সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অবঃ) হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।
বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ (FBCCI)-এর আহ্বায়ক জাকির হোসেন নয়ন, সদস?্য সচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন এবং পরিষদের উপদেষ্টা গিয়াসউদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে শুরু হয় আরেক আন্দোলন-এফবিসিসিআইকে সংস্কার আন্দোলন। সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি পদক্ষেপে অগণিত বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৬টি প্রস্তাব পেশ করে এবং বেশিরভাগ প্রস্তাবনা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয় কিন্তু ব?াণিজ?্য সংগঠন বিধি-২০২৫ এ সদস?্যদের বাৎসরিক চাঁদার হার বৃদ্ধি, ডিভিসিসহ নিরীক্ষা প্রতিবেদক বাধ?্যতামূলক করার কারণে ব?্যবসায়ীরা সংক্ষুব্ধ হন। সকল প?্যানেল প্রধানের দাবির প্রেক্ষিতে ডিভিসিসহ কাগজপত্র জমাদানের সময় বৃদ্ধি করা হয়।
বিগত ফ?্যাসিস্ট সরকারের দোসররা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জনবিচ্ছিন্ন বিভিন্নবিষয় নিয়ে হাইকোর্টে ৬টি রীট দায়ের করে। মহামান্য হাইকোর্ট থেকে রীট মীমাংসার পর গতকাল ২১ আগস্ট ২০২৫ ইং তারিখে বিকালে নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ড পুনঃগঠন করা হয়েছে।
ফেডারেশনের সাধারণ সদস?্যরা অধীর আগ্রহে ভোট উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা, গত ১৫ বছরে সদস?্যরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দেশের সকল প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়া নির্বাচন ব?্যবস্থা পুনরুত্থানের উপর গুরুত্বারোপ করছেন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সহ ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করছেন। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের রোডম?্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এফবিসিসিআই দেশের ৪.৫ কোটি ব?্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। বিগত ফ?্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা পাচারের কারণে অসংখ্য ব?্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। সুদের হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদে?্যাক্তাদের এত উচ্চ সুদ দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার সুফল ও এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর জুলাইয়ে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১.৬৬% এ বছর জুলাইয়ে ৮.৫৫% এ নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গতবছর জুলাইয়ে ছিল ২০.৪৮ বিলিয়ন ডলার এ বছর জুলাইয়ে ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সর্বোপরি প্রেসিডেন্ট ট?্রাম্পের বিভিন্ন দেশে পাল্টা ট?্যারিফ আরোপের ফলে গ্লোবাল বিজনেস অর্ডার নতুন রূপ ধারণ করবে। এটা নতুন নতুন চ?্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা তৈরি করবে। সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কি না, সেটানির্ভর করবে আমাদের নতুন নেতৃত্বের দক্ষতার উপর।
এছাড়া ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হতে যাচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গত এক বছরে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতি ও বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনের চিন্তা গ্র্যাজুয়েশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে তৎকালীন সরকার করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ সালে গ্র্যাজুয়েশন করলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় গ্র্যাজুয়েশন বিলম্ব করাই যৌক্তিক বলে ধারণা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি পরিবর্তন হবে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের মতো দেশগুলো ট্যারিফ আরোপ করবে। যেসব দেশের সঙ্গে এখন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে, সেখানে সুবিধাগুলো আর পাবে না বাংলাদেশ। কারণ তখন এ দেশকেও গ্র্যাজুয়েট হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে।
এ অবস্থায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গ্র্যাজুয়েশনের সময় বিলম্বিত করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন ব?্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ চাইলে এখানে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট পলিসি কমিটির মূল্যায়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অনুমোদন এবং সাধারণ পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়ে সময় চাইতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের গ্র্যাজুয়েশন বিলম্বিত করেছে।
এ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় এনে এফবিসিসিআই নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ও সাধারণ ব?্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে বাধাপ্রদানকারী অপশক্তিকে প্রতিহত করা জরুরি। কেননা, একটা পক্ষ নির্বাচন কে বাধাগ্রস্ত করে দেশের ব?্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বিগত স্বৈরাচারীদের ফেরার পথ মসৃণ করতে চায়, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ এফবিসিসিসআই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধন?্যবাদ জানাতে চাই নির্বাচন বোর্ড ও আপিল বোর্ড পুনর্গঠন করার জন্য। দেশ এখন নির্বাচনের মহাসড়কে। আশা করি, নির্বাচন বোর্ড শিগগিরই এফবিসিসিআই নির্বাচনের তফসিল পুনরায় প্রকাশ করে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ?্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশের ৪.৫ কোটি ব?্যবসায়ীদের দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ চারকোল ম?্যানুফ?্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন; পরিচালক, ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি