শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বনাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়
মুহাম্মাদ হাসিব আলী
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বনাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়? এ প্রশ্ন আজ আমাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে পুরো সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। যে বিদ্যাপীঠগুলো জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মূল্যবোধের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা, সেগুলোই আজ হয়ে উঠেছে সংঘাত ও সহিংসতার কেন্দ্র।
সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবারও যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা যেন এই প্রশ্নেরই এক নির্মম উত্তর।
২০২৪ সালের নভেম্বরেও এই দুই কলেজের মাঝে সংঘর্ষ হয় যেখানে দেড় শতাধিক ছাত্র আহত হয়। আবার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজ এক সংঘর্ষে জড়ায় যেখানে ১৮ জন ছাত্র আহত হয়। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একে অপরের প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনাও খুব বেশি পুরাতন নয়। মাঝে মাঝেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন মারামারি শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতাকে নষ্ট করছে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চয়তার দিকে। বইয়ের পাতায় যেখানে জ্ঞান আর যুক্তির চর্চা হওয়ার কথা, সেখানে এখন উড়ছে ইট-পাথর আর ভাঙচুরের ধুলো। যে সবুজ ক্যাম্পাসে তারুণ্যের উচ্ছলতা থাকার কথা, সেখানে বিরাজ করছে এক চাপা আতঙ্ক। এই চিত্র আমাদের জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত।
যে গর্ববোধ শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে, নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে সেরা করার জন্য উৎসাহিত করে, সেই গর্বই যখন অন্ধ বিদ্বেষে পরিণত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে এক বিষাক্ত ব্যাধি। এই ব্যাধি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়ে দিচ্ছে যে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হলে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে হয়। এটি এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতা, যা থেকে জন্ম নেয় সংঘাত, মারামারি এবং প্রতিশোধের স্পৃহা। এ ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সুনামই ক্ষুণ্ণ করে না, বরং এর মধ্য দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে এক অন্ধকার পথের দিকে ঠেলে দেয়।
শিক্ষাঙ্গনের এই সংঘাতের গভীরতা শুধু ক্যাম্পাস জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই বিভাজন পরবর্তীতে আমাদের কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি এবং সামাজিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। এক প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতি এক ধরনের বৈরী মনোভাব পোষণ করে, যা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা তখন ভুলে যাই যে আমরা সবাই একই জাতির সন্তান এবং আমাদের লক্ষ্যও এক তা হলো একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা।
এই সংঘাতের বৃত্ত ভাঙতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৌরব তার শিক্ষার মান, গবেষণার সাফল্য এবং শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া উচিত, সংঘাত বা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে নয়। শিক্ষক, অভিভাবক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একযোগে কাজ করতে হবে এই অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে, সত্যিকারের বিজয় আসে অন্যের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন এবং সহযোগিতার মাধ্যমে, সংঘাতের মাধ্যমে নয়।
পরিশেষে, এই প্রশ্নটি আমাদের নিজেদের কাছেই বারবার করতে হবে: এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়? এই লড়াইয়ের শেষ সেখানেই, যেখানে আমরা অস্ত্র ফেলে কলম হাতে তুলে নেব, যেখানে ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিবর্তে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব। তখনই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হবে সত্যিকারের জ্ঞানের তীর্থস্থান, আর আমাদের তরুণ প্রজন্ম হবে এক শান্ত, প্রগতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের কারিগর।
লেখক : মুহাম্মাদ হাসিব আলী শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
