অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি

মো. সামছুল আলম

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টি চাহিদাপূরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে তা না, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বিশেষ অবদান রাখছে। বাংলাদেশে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। মৎস্য খাত সবচেয়ে উৎপাদনশীল এবং গতিশীল খাতগুলোর মধ্যে একটি হওয়ায়, গত কয়েক দশক ধরে অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

এই খাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য সম্ভাবনার দাবি রাখে। মৎস্য খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.৫৩ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (বিবিএস ২০২৪) সামগ্রিক কৃষি খাতে মৎস্য খাতের অবদান ২২.২৬ শতাংশ। জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ বা প্রায় ২ কোটি মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য মৎস্য খাতের অধীনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিযুক্ত। বাংলাদেশ মাছ, চিংড়ি এবং অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে; যা মোট জাতীয় রপ্তানি আয়ের ০.৯১ শতাংশ অবদান রাখে (EPB- 2024)। ২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ এবং মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪,৫৩১.৮৬ কোটি টাকা আয় করেছে। এই খাতটি সমস্ত ব্যবহৃত প্রাণিজ প্রোটিনের (৬০ শতাংশ) প্রধান অংশ সরবরাহ করে।

তবে বর্তমানে নিরাপদ মাছ উৎপাদন ও দেশীয় মাছ রক্ষা করে তার সরবরাহ বৃদ্ধি করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা, অনাবৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের ওপর ক্রমশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নদীগুলোতে লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের ফলে মিঠা পানির মাছ ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন ঘটছে। মাছের আবাসস্থল, বিচরণক্ষেত্র, অভিপ্রয়াণ ও প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ুর ধারাবাহিক ক্রম অবনতির ফলে মাছের অনেক আচরণগত বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজাতি-বৈচিত্র্যেও।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এসব জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এলক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাওড়ের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং গ্রামবাংলায় এ খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়ও বাড়বে। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে। গড়ে ওঠবে মেধাবী জাতি। সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। পূর্ণতা পাবে দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় পুকুর-দিঘির পানির স্তর কমে যাচ্ছে। সারাবছর যেসব পুকুরে পানি থাকত, সেসব পুকুর মৌসুমি পুকুরে (শুধু বর্ষায় পানি থাকে) রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসস্থল, রাস্তা-ঘাট, বেড়িবাঁধ ও শিল্পকারখানা নির্মাণ, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করার ফলে আবাদি পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য উৎপাদন তথা দেশীয় মাছ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষকরে জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ ধরার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬১ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ রয়েছে।

২০১৫ সালের আইইউসিএন ((IUCN) এর তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে দেশীয় এ মাছ যাতে মানুষের পাতে আবার ফিরিয়ে আনা যায় এবং দেশীয় মাছ যাতে বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এ লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে ১১০টি দেশীয় মাছ সরবরাহ করা হয়েছে, যা দেশীয় মাছের বংশগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।

এছাড়া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ৪১ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেসব অঞ্চলে এ মাছ বিলুপ্ত হবে, লাইভ জিন ব্যাংক থেকে সে অঞ্চলে মাছের পোনা সরবরাহ করা হবে। যাতে সে অঞ্চলে নতুন করে দেশীয় মাছের বিস্তার হতে পারে। কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আধার। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগ-- প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষকরে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন।

দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অতুলনীয়। এ কারণেই দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করা দরকার। অতিমূল্যবান এ দেশি মাছ রক্ষা করতে হলে মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধজলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায়, সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো- ধানখেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানখেতে মিনি পুকুর তৈরি; অপরিকল্পিত বালাইনাশক ব্যবহার না করা, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, কারেন্ট জাল, চায়না দুয়ারি ও ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য পুকুরে বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সঙ্গে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় প্লাবনভূমি এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

বিশেষকরে অভ্যন্তরীণ মাছ চাষে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর-সংস্থার সহযোগিতায় সরকার বেশ কয়েকটি বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এইসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে উন্মুক্ত জলাশয়ের জৈবিক ব্যবস্থাপনা, সম্প্রদায়ভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা, বিল নার্সারি স্থাপন, বিপন্ন প্রজাতির মাছের ছানা মজুদ, প্রজনন ও অভিবাসন সহজতর করার জন্য মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য অভয়াশ্রম স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, জলাশয়ে খাঁচা ও খোঁয়াড় চাষ সম্প্রসারণ, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন, জেলেদের পরিচয়পত্র প্রদান, গণসচেতনতামূলক প্রচারণা, সমাবেশ, সভা, ইলিশ অভয়ারণ্য স্থাপন, মৌসুমি মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা, দরিদ্র জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ, নগদ প্রণোদনা হিসেবে গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি, ভ্যান ও রিকশা ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে জেলেদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা, মাছ সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে স্মার্ট প্রযুক্তি গ্রহণ ইত্যাদি। এইসব কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো- মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের প্রোটিন সরবরাহ বৃদ্ধি এবং আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জেলে এবং অন্যান্য অংশীদারদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, দেশের ইলিশ, মৎস্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য নির্বাচিত জলাশয়ে প্রায় ৬৬৯টি মৎস্য অভয়ারণ্য এবং ছয়টি ইলিশ অভয়ারণ্য স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের কারণে, উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিপন্ন প্রজাতির প্রাচুর্য দেখা গেছে, যা জলজ জীববৈচিত্র্যকে উন্নত করছে। বিশেষ করে, দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, উন্মুক্ত, বদ্ধ ও সামুদ্রিক এরিয়ায় নিরাপদ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা এবং মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রতিবছরের ন্যায় এবারও জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করা হচ্ছে। এবার (২০২৫) ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে ১৮ আগস্ট হতে ২৪ আগস্ট জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। মাছের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জীবন-জীবিকার ও বেঁচে থাকার। অতীতকাল থেকেই এ দেশ ছিল মাছের ভাণ্ডার। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হলো মাছ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদার একটি বড় অংশই পূরণ হয় মাছ থেকে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬২.৭ ভাগ আসে মাছ থেকে। এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চাষের মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৮ হাজার টন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিশাল সম্ভাবনাময় জলসম্পদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ সালে মোট ৫০.১৮ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। যেখানে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (কৃষি) মোট মাছ উৎপাদনে ২৮.১৩ শতাংশ (১৪.১২ লক্ষ মেট্রিক টন) এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (কৃষি) ৫৯.৩৪ শতাংশ (২৯.৭৮ লক্ষ মেট্রিক টন) অবদান রাখে।

সুতরাং, মোট মাছ উৎপাদনের ৮৭.৪৭ শতাংশ আসে অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষ থেকে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণ এবং অভ্যন্তরীণ চাষের মৎস্য আহরণের বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২.০৬ শতাংশ এবং ৪.৪২ শতাংশ। অন্যদিকে, সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ৬.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন এবং মোট মৎস্য উৎপাদনে এর অবদান ১২.৫৩ শতাংশ, বৃদ্ধির হার ৭.৪৭ শতাংশ। এছাড়া FAO -এর প্রতিবেদন ‘The State of World Fisheries and Aquaculture 2022 অনুসারে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ক্রাস্টাসিয়ান্স আহরণে বিশ্বে ৮ম এবং কোস্টাল ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্বের ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে। ইলিশ (ইলিশ) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এ মাছের প্রতি সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। সরকারের নানা উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বাজারে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যায় এ মাছ।

ইলিশ (বৈজ্ঞানিক নাম : তেনুয়ালোসা ইলিশা) বাংলাদেশের বৃহত্তম একক প্রজাতির মৎস্যের মধ্যে একটি; যা দেশের মোট মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১০.৫৫ শতাংশ ইলিশ থেকে আসে। ইলিশ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ৭.৩৩ শতাংশ। উল্লেখ্য যে, ইলিশকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ বছর ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৫.২৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অন্যদিকে চিংড়ি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। ২০২৩-২৪ সালে মোট চিংড়ি ও চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ২.৬০ লক্ষ মেট্রিক টন এবং এর বর্তমান বৃদ্ধির হার ৩.৯৯ শতাংশ। উপকূলীয় জলজ চাষে চিংড়ি এবং ফিনফিশ উভয়ই চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং গত ২০ বছরে মোট চিংড়ি উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। তদুপরি, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমা আমাদের মৎস্যসম্পদের অন্যতম প্রধান ভাণ্ডার। দেশের এই সমুদ্রসীমার টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে Marine Protected Area (MPA) ঘোষণা এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু রয়েছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে Marine Reserve, নিঝুমদ্বীপ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা এবং নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাগুলো সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে।

ফলে দেশের সামুদ্রিক জলসীমার ৮১০১ বর্গকিলোমিটার (৮.৬৪ শতাংশ) এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG 14.5) অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সরকারের নানা উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের মৎস্য খাতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য উৎপাদনে আমাদের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দেশে বদ্ধজলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ের এখনও বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; যাতে করে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে।

উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞদের অভিমত অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এসব জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এলক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাওড়ের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং গ্রামবাংলায় এ খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়ও বাড়বে। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে। গড়ে ওঠবে মেধাবী জাতি। সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। পূর্ণতা পাবে দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি।

লেখক : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।