পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে কেন কমছে না
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়বে এবং বিশ্ববাজারে দাম কমলে বাংলাদেশেও কমবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে এখানে খুব কম ক্ষেত্রেই নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য- চাল, অপরিশোধিত সয়াবিন, চিনি, জ্বালানি তেল ও তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিক হারে। দুই-আড়াই বছরে বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের বেশিরভাগের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এলেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) ১৮ আগস্টের প্রতিবেদনে দেখা যায়, থাইল্যান্ডে এখন ৫ শতাংশ ভাঙা চালের মেট্রিক টনপ্রতি দর ৩৮১ মার্কিন ডলার (এফওবি মূল্য, অর্থাৎ জাহাজভাড়া ছাড়া), যা এক বছর আগে ছিল ৬১৬ ডলার। এক বছরে দাম কমেছে ৩৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে চালের দাম বরাবরই বাড়তির দিকে। বাংলাদেশ গত জুন পর্যন্ত আগের ১ বছরে ১৪ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। তারপরও দাম কমছে না। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী গত মে মাসের শেষ দিকে ঢাকার বাজারে মোটা চালের দাম ছিল ৫২-৫৫ টাকা কেজি, যা এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, চিনি, জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর পেছনে বৈশ্বিক প্রভাবের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল নীতিও দায়ী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশ কিছু কর্মসূচি নেয়, যার ইতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। ডলারের দরপতন থামানো গেছে; বেড়েছে রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও প্রবাসী আয়ও। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নাটকীয়ভাবে কমাতে পারলেও বাংলাদেশ চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এখন ঋণাত্মক, অর্থাৎ সেখানে পণ্যের দাম আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। অর্থনৈতিক সংকটে পড়া পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছিল, যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতে মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, নেপালে তা ২ দশমিক ৭২।
এর বিপরীতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত জুলাই মাসে ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে বেশ পিছিয়ে থাকবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিংবা প্রবাসী আয়ের চেয়েও সাধারণ মানুষের কাছে নিত্যপণ্যের দামের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি যে হারে কমেছে, তাতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো আগে ১০০ টাকায় যে পণ্য কেনা যেত, বর্তমানে সেই পণ্য কিনতে লাগবে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু গত এক বছরে মানুষের আয় তো সেই পরিমাণ বাড়েনি।
অন্যদিকে বেকারত্ব বেড়েছে। অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রের অর্জন ধরে রাখতে হলে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ কমাতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামনে দুটি উপায় আছে। সরকারি চ্যানেলে কম দামে খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো এবং বাজার তদারকি জোরদার করা। বহু বছর ধরেই বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চলে এলেও অতীতে কোনো সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে। অন্তর্বর্তী সরকার সে চাপ উপেক্ষা করতে পারলে মূল্যস্ফীতি শ্রীলঙ্কার মতো ঋণাত্মক করতে না পারলেও সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা অসম্ভব নয় বলে মনে করি।
