তরুণরাই বাংলাদেশের টার্নিং পয়েন্ট
প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। ছোট্ট এই ভূখণ্ডে প্রায় ১৭ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে, যার একটি বিশাল অংশ প্রায় ৬০% হচ্ছে তরুণ। বিশ্বের বহু উন্নত দেশ যেখানে বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে, সেখানে বাংলাদেশের এই তরুণ জনমিতিক গঠন বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সম্ভাবনাকে আমরা এখনও যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।
বর্তমান বাস্তবতা : একক খাত নির্ভরতার ঝুঁকি বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% আসে তৈরি পোশাক বা আরএমজি খাত থেকে। দেশের অর্থনীতির সিংহভাগই এই একক খাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আরএমজি খাতের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত রয়েছে ব্যাংক, বিমা, পোর্ট, বিমান চলাচল, যোগাযোগ, আইটি, ট্যুরিজম, পরিবহনসহ আরও অনেকগুলো খাত। একদিকে যেমন এটি অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে এই একক খাত নির্ভরতা আমাদের জন্য একটি মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশ্ব রাজনীতির অস্থিরতা, বাণিজ্যনীতির হঠাৎ পরিবর্তন কিংবা পরিবেশগত কোনো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে তৈরি পোশাক খাতে যদি বড় কোনো ধস নামে, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়তে পারে। এমন একটি পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়েই দেখা গিয়েছে, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে বসে। এখন সব মিলিয়ে আমাদের শুল্ক দিতে হবে ৩৬.৫ শতাংশ। এই ঘোষণায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির খাতে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয় এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি একেবারেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- একক খাত নির্ভরতার ঝুঁকি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় : আমরা কি শুধু একটি খাতের উপর নির্ভর করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চাই, নাকি বহুমাত্রিক, বিকল্পমুখী এবং টেকসই উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করবো?
মানবসম্পদ রপ্তানি হতে পারে একটি কার্যকর বিকল্প : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্তরণের পথ খুঁজতে গেলে একটি বিষয় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মশক্তির বৈদেশিক শ্রমবাজারে সুপরিকল্পিত প্রবাহ। এটি শুধু একটি বিকল্প নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতায় অন্যতম দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং কৌশলগত দিক থেকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই পথ। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও কাঠামো এখনও একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় রূপান্তর লাভ করতে পারেনি।
অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখন কর্মক্ষম জনবল সংকটের মুখোমুখি। জনসংখ্যা হ্রাস, বার্ধক্য এবং জন্মহার কমে যাওয়ার ফলে ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতেও দক্ষ কর্মীর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে এক বিরল সম্ভাবনার জানালা যা কাজে লাগাতে পারলে আমাদের অর্থনীতি বৈশ্বিকভাবে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী, যদি প্রাসঙ্গিক শিক্ষা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়, তবে তারা শুধু শ্রমঘন পেশায় নিয়োজিত হয়ে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী শ্রমিকেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা হয়ে উঠতে পারে জ্ঞাননির্ভর উদ্যোক্তা, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পেশাজীবী এবং এমন এক বিশ্বসম্পৃক্ত প্রজন্ম যারা একদিকে দেশের অর্থনীতিকে বৈদেশিক বাজারে সংযুক্ত করবে, অন্যদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকেও পুনর্নির্ধারণ করবে। এই কৌশলগত দূরদর্শিতা চীন ও ভারত অনেক আগেই ধারণ করেছে। পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ, বিদেশমুখী মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অভিবাসন ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে আজ এই দুটি দেশের নাগরিকরা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে কার্যকর উপস্থিতি গড়ে তুলেছে। এর ফলে তারা শুধু রেমিট্যান্স অর্জনই করেনি, বরং তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সংযোগ, কূটনৈতিক প্রভাব এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের সম্ভাবনাও বহুগুণে বেড়েছে।
বাংলাদেশও চাইলে একই কৌশল অনুসরণ করতে পারে- তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কার্যকর ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা এখনও নামমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিযোগিতায় আবদ্ধ, যেখানে বাস্তব দক্ষতা কিংবা প্রযুক্তিগত সক্ষমতার গুরুত্ব একরকম উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। এখানে ব্যর্থতার দায়ভার বহন করছে অপরিকল্পিত শিক্ষানীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সামাজিক অবক্ষয় এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর ভ্রান্ত বিনোদনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রকৃত জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের চেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সহজ পন্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ড কিংবা অর্থহীন ডিজিটাল সময় ব্যয়ে তরুণদের সম্পৃক্ততা ক্রমেই উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বারবার পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষার গুণমানে। সর্বশেষ চালু হওয়া মূল্যায়ন পদ্ধতিকে অনেক শিক্ষাবিদই অপেশাদার ও অপরিণত বলে অভিহিত করেছেন। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং কৃত্রিমভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার এই দুরবস্থার প্রতিফলন আন্তর্জাতিক সূচকেও পরিলক্ষিত। ২০২১ সালের গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে আমাদের অবস্থান ১৩৪টি দেশের মধ্যে ১২৩তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। এই পরিসংখ্যান শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সক্ষমতা সম্পর্কে একটি গুরুতর সতর্ক সংকেত।
এর পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো- শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের ঘাটতি। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, জাতীয় বাজেটে জিডিপির অন্তত ৬% শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে গড়ে মাত্র ১.৮৩% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে এই দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা তরুণদের একটি বড় অংশ কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে, যার সিংহভাগ তরুণ। আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো এই কর্মহীন তরুণদের একটি বড় অংশ সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক, চাঁদাবাজি, সাইবার প্রতারণা, কিংবা ধর্মীয় চরমপন্থার মতো অপকর্মে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে, যা শুধু অর্থনীতিকেই নয়, সমাজের স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। তরুণদের এই অপচয় রোধ করতে হলে এখনই প্রয়োজন একটি মৌলিক, যুগোপযোগী এবং কৌশলগত রূপান্তর যেখানে শিক্ষা হবে দক্ষতা অর্জনের হাতিয়ার এবং মানবসম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে দেশ হবে বৈশ্বিক মানবসম্পদ শক্তির অন্যতম কেন্দ্র।
এখনই যা করা দরকার : বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনকে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা অনুযায়ী নতুনভাবে রূপ দিতে হবে। উন্নয়নের মূল স্তম্ভ হতে হবে ‘মানুষ’ তাদের দক্ষতা, শিক্ষা, সৃজনশীলতা এবং নৈতিকতা।
কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার বিস্তার : পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটগুলোর আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকমানের কারিকুলাম তৈরি।
বিদেশগামী কর্মীদের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রশিক্ষণ : তারা যেন বিদেশে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে।
জনগণের মানসিকতা পরিবর্তন : তরুণরা যেন শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে চায়, কাজে গর্ববোধ করে।
সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন : প্রশিক্ষণ, ভিসা ও বিদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ভোগান্তি যেন না হয়
সবশেষে বলতেই হয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই দেশের তরুণদের উপর। তারা যদি সঠিকভাবে দক্ষ হয়ে বিদেশে কাজ করতে পারে, তাহলে সেটা হবে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এবং স্থায়ী আয়ের উৎস। শুধু রেমিট্যান্স নয়, তারা বিদেশে বসেও দেশের অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
সুতরাং এখনই সময়, একক খাত নির্ভরতা থেকে সরে এসে বহুমুখী, মানবসম্পদনির্ভর, টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার। তাহলেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারবে শুধুই জনসংখ্যায় নয়, গুণগত মানেও। আর এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ, পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক
ডিন, ফাকাল্টি অব সাইন্স এবং ফাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং;
বিজিএমইএ ইউনিভারসিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা
