সমকালীন শিক্ষার মানোন্নয়নে গুণগত অগ্রগতি প্রয়োজন

মো. বিল্লাল হোসেন জুয়েল

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গুণগত শিক্ষা একুশ শতকের একটি অন্যতম চাওয়া। গুণগত শিক্ষা এমন একটি পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা যার উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষার্থীকে সামগ্রিকভাবে সাহায্য করা যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে একজন পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল নাগরিক হয়ে ওঠে। একবিংশ শতাব্দীর এই পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একুশ শতকের এই পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে অভিযোজন করতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সহযোগিতা এবং নেতৃত্ব, অভিযোজনের যোগ্যতা অর্জন, উদ্যোক্তা, কার্যকর মৌখিক এবং লিখিত যোগাযোগের সক্ষমতা, তথ্য ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করা এবং কৌতূহলী হওয়ার যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা ও অবারিত সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করে জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষিত জাতি সমাজের সম্পদ। কিন্তু শিক্ষা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে সে সম্পদ অসাড়ে পরিণত হয়। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান ত্রুটিগুলো চিহ্নিতকরে গুণগত শিক্ষার দিকে আমাদের ধাবিত হতে হবে। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন, যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগতমান অর্জন বলতে এর গুণগত মান নিশ্চিতকরণকে বোঝায়। শিক্ষার মান্নোনয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান উপাদানগুলো হলো- শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক, শিক্ষাক্রম, শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন, শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ এবং ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে এ সব উপাদানের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমানের টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। বর্তমান যুগকে আমরা তথ্য-প্রযুক্তির যুগ বলে অভিহিত করি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একটি গ্রন্থাগারও বটে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সন্তানদের ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তায়। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা নয় বরং ফলাফল নিয়ে অভিভাবকদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা এবং অপ্রাপ্তির হতাশা শিশুদের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন তুলবো না কারণ যে শিক্ষক বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন সেই শিক্ষকই কোচিং পরিচালনা করছেন। কোচিং এ পড়লে ভালো ফলাফল করে, না পড়লে ভালো ফলাফল করে না। এখানে আমি শিক্ষকদের পাঠদানে সদিচ্ছার অভাবকে গুরুত্ব দিব। পাশাপাশি শিক্ষকদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সরকারের স্বদিচ্ছার অভবও এর জন্য কম দায়ী নয়।

শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি একদিকে যেমন সমাজ নির্ধারণ করে, তেমনি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র। যে জাতি শিক্ষা ও শিক্ষককে যত বেশি গুরুত্ব দেয়, তারা তত দ্রুত উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে একসময় শিক্ষকদের যে রকম শ্রদ্ধার আসনে দেখা হতো বর্তমান অবস্থা সে রকম নয়। এজন্য শিক্ষকরাও দায়ী। শ্রেণিকক্ষে না পড়ানো, ঠিকমতো ক্লাসে না আসা, প্রাইভেট ও কোচিংয়ের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া, নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষকরা তাদের আগের অবস্থান হারিয়েছেন। যদিও অধিকাংশ শিক্ষককে এরকম অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না, এর জন্য দায়ী গুটিকয়েক শিক্ষক। তিন যুগ আগের শিক্ষকরা এখনকার মতো এত প্রশিক্ষণ পেতেন না বা তারা হয়তো এতটা দক্ষও ছিলেন না। কিন্তু পড়ানোর প্রতি তাদের দরদ বা নিষ্ঠা নিয়ে খুব কমই প্রশ্ন তোলা যায়। সুতরাং শিক্ষকরা যে তাদের মর্যাদার অবস্থান হারিয়েছেন, এতে শুধু রাষ্ট্রীয় বা শিক্ষাব্যবস্থার দায় দেখলে চলবে না, শিক্ষকদের নিজেদের ঘাটতিটুকুও বিবেচ্য। শ্রেণিকক্ষই হবে শিক্ষকদের যথানিয়মে সুষ্ঠু ও উন্নত পাঠদানের নিমিত্তে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার। শিক্ষকদের নিয়মিত, সফল, আধুনিক আন্তরিকতার সাথে উন্নত পাঠদানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলেই বাড়তি ও আলাদা প্রাইভেট পড়া ও কোচিং করার দরকার হয় না। বর্তমানে দেশে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর নিদর্শন ও প্রমাণ রাখতে সক্ষম হচ্ছে। প্রাইভেট পড়া হোক আর কোচিং করা হোক সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষই যথেষ্ট। কোচিং সেন্টার নয়, শ্রেণিকক্ষই হোক শিক্ষাদানের প্রাণকেন্দ্র। গুণগত শিক্ষা হলো- এমন শিক্ষা যা শিক্ষার্থীদের তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে সাহায্য করে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, গতানুগতিক পদ্ধতির সাথে প্রযুক্তির সুবিধা সংযুক্ত করা, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষকদের তাদের পাঠদান কৌশল এবং বিষয়গত জ্ঞান উন্নত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে দক্ষ এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে আয়োজিত ইন-হাউজ প্রশিক্ষণ (In house training) এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাবে এবং সকল শিক্ষক দক্ষ হয়ে উঠবে।

গুণগত শিক্ষার উপাদান : গুণগত শিক্ষার উপাদান হিসেবে মানসম্মত শিক্ষকের পর্যাপ্ততা, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, মানসম্মত শিখন সামগ্রী ব্যবহার, শিখন-শেখানো পদ্ধতির ও কৌশলের কার্যকর ব্যবহার, নিরাপদ ও সহযোগিতামূলক শিখন পরিবেশ, উপযুক্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সুসম্পর্ক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে হৃদ্যতা, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হবে।

গুণগত শিক্ষার চ্যালেঞ্জ : গুণগত শিক্ষার মান অর্জন করতে হলে, শিক্ষক সংকট ও দক্ষতার অভাব, প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টার, শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতির বিস্তার, শিক্ষা বাজেটের অপ্রতুলতা আমাদের এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

গুণগত অগ্রগতিতে শিক্ষকের ভূমিকা : শিক্ষার গুণগত মান অগ্রগতিতে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রেণিকক্ষকে প্রাণবন্ত, শিক্ষক কেন্দ্রিক না হয়ে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠদান, আইসটি দক্ষতা অর্জন করে তা কাজে লাগানো, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে ক্লাস পরিচালনা করা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নতুন পদ্ধতি শেখা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হৃদ্যতা সম্পর্ক, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও আবেগ অন্বেষণে উৎসাহিত করা, শ্রেণিকক্ষে ইতিবাচক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, অভিভাবকদের সাথে সহযোগিতা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা, শ্রেণিকক্ষে আধুনিক শিক্ষাদানে শিক্ষককে অবদান রাখা উচিত। ‘শিক্ষক’ এমন একটি শব্দ যে শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, অন্তহীন ত্যাগ, মূল্যবোধ, আদর্শবান, অনুপ্রেরণাদানকারী, সহযোগী, শুদ্ধতা, সহায়তাকারী, ব্যক্তিত্বের একটি ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একটি ব্রত।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হতে হবে হৃদ্যতাপূর্ণ : শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে পাঠদান করলে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন হতে বাধ্য। পিয়ার্সন ও হেইনের (২০০৬) একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষার প্রতি মনোযোগ বাড়ায়। অর্থাৎ ইতিবাচক সম্পর্ক শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তার শিখন ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (সমাজকর্ম)

বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা