ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

কবির উদ্দিন
বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

বাংলাদেশের ছোট বসতি থেকে বড় শহরগুলো আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বল অবকাঠামো এবং পরিবেশগত বিপর্যয় আমাদের নগরগুলোকে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। এই সমস্যার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন এবং নগর উন্নয়নের জন্য স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান, মহাপরিকল্পনা (মাস্টার প্ল্যান) এবং ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) সঠিকভাবে প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব। উপরন্তু, নগর পরিকল্পনা প্রায়শই বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক; সবার মনোযোগ থাকে কেবল বড় শহরগুলোর দিকে। আজ আমাদের শহরগুলোতে যানজট, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা এবং বায়ুদূষণের মতো সমস্যা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের কেন্দ্রে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক চাপ এবং অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবনগুলো এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে। সংকীর্ণ রাস্তা, রাস্তার ধারে লম্বা সীমানা প্রাচীর, দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সবুজ স্থানের বিলুপ্তি নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। দেশের অনেক বসতি এলাকায় এমন পরিস্থিতি যে, এম্বুলেন্স তো দূরের কথা, দুটি রিকশাও পাশাপাশি প্রবেশ করতে পারে না। অনেক জায়গায় খাল ও নদীর প্রবাহ বন্ধ করে বাড়ি নির্মাণের প্রবণতা বাড়ছে, যা ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। যদি এই অপরিকল্পিত নগরায়ণ অব্যাহত থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়বে। শহরের দূষিত নদী ও খাল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অপর্যাপ্ত আবাসন এবং গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাবে সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে এবং শহরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। শহরগুলো তাদের প্রাণশক্তি হারিয়ে এক বিশৃঙ্খল জনসমুদ্রে পরিণত হবে। নগর পরিকল্পনার জন্য মূলত তিন ধরনের পরিকল্পনা জরুরি- স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান এবং ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি)। প্রায়শই শোনা যায় যে ঢাকা বা অন্যান্য পৌরসভায় মাস্টার প্ল্যান রয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় : সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা মেয়ররা কি সত্যিই জানেন মাস্টার প্ল্যান কী এবং সেটি কার্যকর আছে কি না? মাস্টার প্ল্যান একটি শহরের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য একটি সাধারণ রূপরেখা প্রদান করে, যেখানে জোনভিত্তিক নির্দেশনা থাকে। তবে এর বড় সীমাবদ্ধতা হলো সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্যের অভাব। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বাড়ি নির্মাণ করতে চান, তবে রাস্তার জন্য কতটুকু জায়গা ছেড়ে দিতে হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রায়শই থাকে না। এই কারণেই মাস্টার প্ল্যানকে কার্যকর রূপ দিতে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) অপরিহার্য। ডিএপি ক্ষুদ্র পরিসরে বিশদ পরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়নের সুযোগ দেয় এবং স্থানীয় বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়। মাস্টার প্ল্যান একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র, যা আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা, সড়ক, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ শহরের জন্য কার্যকর মাস্টার প্ল্যান নেই, এবং যেখানে আছে সেখানেও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয় না। ডিএপি প্রণয়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ডিএপি মাস্টার প্ল্যানের নীতিগুলোকে ছোট এলাকার প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করে, যাতে স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা করা যায় এবং সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এর বড় সুবিধা হলো, প্রয়োজন হলে ডিএপি সহজেই হালনাগাদ করা যায়, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল নগর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সহায়ক। অন্যদিকে, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান হলো একটি উচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা, যা শহরের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে এবং মাস্টার প্ল্যান ও ডিএপিকে সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সমন্বয় করে এটি নগর উন্নয়নের একটি রূপরেখা প্রদান করে। এই তিন ধরনের পরিকল্পনা- মাস্টার প্ল্যান, ডিএপি ও স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান- সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলেই টেকসই নগর উন্নয়ন সম্ভব। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি- সঠিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, আইন ও নীতির কঠোর প্রয়োগ, এবং অপরিকল্পিত ও অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে নীতি অনুসরণ। আমরা প্রায়ই দেখি, কোনো বিল্ডিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে পরে জানা যায় যে সেটি অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল, এ প্রবণতা বন্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে শক্তিশালী করতে হবে, এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ইসিমোড, নেপাল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত