হারিয়ে গেছে জলতরঙ্গের চাওয়াই

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘চাওয়াই’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বয়ে চলা জীবনের প্রতিচ্ছবি। অনিন্দ্য সুন্দর শৈশবের ডানপিটে দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে খরস্রোতা চাওয়াই এর বুকে। বর্ষার উত্তাল যৌবনা চাওয়াই ছিল অপূর্ব সুন্দর। নদীটি সারাজীবন পলি বহন করে দুকূল উর্বর করেছে। কিন্তু মায়ায় আবদ্ধ দুকূলকে কখনোই প্লাবিত করেনি। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে যেমন নদীকে কেন্দ্র করে। ঠিক তেমনি প্রাচীন পুন্ড্র নগরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একটি জনপদের বিকাশ ঘটেছিল এই চাওয়াই নদীকে কেন্দ্র করে। বহু আবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যদিয়ে চাওয়াই নদী বিধৌত অববাহিকার তীরে গড়ে উঠেছিল জগদল বাজার। নদীকে কেন্দ্র করে বাজারভিত্তিক এই জনপদটির যে গোড়াপত্তন ঘটেছিল তার অগ্রযাত্রা এখনও অব্যাহত রয়েছে। চাওয়াই শুধু জলপ্রবাহ নয়, এটি অত্র জনপদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের বুক চিরে প্রবাহিত চাওয়াই শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস নয়, বরং নদীর প্রবাহমান ধারা দুই পাড়ের হাজার হাজার একর জমিকে পলি দ্বারা উর্বরতা দিয়ে এ জনপদের চাষাবাদে ভূমিকা রেখে আসছে অনাদিকাল থেকে।

নদীর দুকূলে গড়ে উঠা গ্রামগুলোর কয়েক হাজার কৃষক এবং ক্ষুদ্র চা-চাষিরা জলসেচ এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত সর্পিলাকার এই নদীটির দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। নদীটির গড় প্রস্থ ৭০ মিটার। নদীটি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলার রামগঞ্জের ভেলাকোবা গ্রামের বিলাঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ভারতের সীমান্তবর্তী গুজরিমারী ও সুকানি গ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী সাতমেড়া ইউনিয়নের অমরখানা ক্যাম্পের প্রান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী তিন দশকেও নদীর গতিশীল স্রোতধারা দৃশ্যমান ছিল। যার কারণে নদী পরিপূর্ণ ছিল দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজ বাস্তুতন্ত্রে সমৃদ্ধ নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিতে।

স্বাভাবিক স্রোতধারার প্রবাহ বিদ্যমান থাকায় চাওয়াই তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমি ছিল পলি দ্বারা উর্বর। এক দশক আগেও নদীর মাছের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত কয়েক হাজার মৎস্যজীবী মানুষ। যে নদীটির আশীর্বাদে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি। নদীর পাশে দীর্ঘ এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল। স্থানীয় অধিবাসীদের অদূরদর্শী কার্যক্রমে সেই নদীটিই সংকুচিত হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার জলতরঙ্গের যৌবন। নদীটির উজানে ভারতীয় অংশে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের ফলে হঠাৎ চাওয়াই তার নাব্যতা হারাতে শুরু করে। এরপর স্থানীয়দের অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন, নদীর জমি দখল করে চা বাগান গড়ে তোলার ফলে নদীটি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানি সম্পদের সুষম বণ্টন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের জীবন-জীবিকার জন্য পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শতবর্ষী ডেল্টা প্লান-২১০০-এর আওতায় ২০২১ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চগড় জেলায় ৫টি নদী ও ১টি খাল খনন করা হয়েছিল। চাওয়াই নদীটিও এই খনন কর্মসূচির আওতাভুক্ত ছিল। পুনঃখননে কিছুদিন নদীতে পানির প্রবাহও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু চাওয়াই তীরবর্তী জনগণের উদাসীনতা। খনন পরবর্তী বাঁধের উভয় পাশের বালু লুটপাট এবং অবৈধভাবে প্রতিদিন বালু ও পাথর উত্তোলন নদীটিকে আবারও সংকুচিত করে ফেলেছে। পুনঃখননের পর নদীর দুপাড়ে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল তা এখন অদৃশ্যমান। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে মুষ্টিমেয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর বালু উত্তোলন, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ বাহিনীর অবহেলা এবং জনসাধারণের অসচেতনতায় প্রাণোচ্ছল স্রোতধারার এই নদীটির প্রবাহ আজ সংকীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে।

জলবায়ুর বৈশ্বিক সংকট দ্বারা আবহাওয়াকে দিন দিন বৈরী করে তুলা। নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারতের পানি প্রত্যাহার। সর্বোপরি নদীর দুকূলের মানুষের দ্বারা সংঘটিত নদীটির প্রতি বিরূপ আচরণ চাওয়াইকে দুর্ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য করেছে। নদীতে অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে ধান চাষের ফলে স্রোতের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয়দের অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি নদীর জমিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করার ফলে চাওয়াই ক্রমাগত মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গেছে। কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলটিতে চাওয়াই নদীর কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর না করেই চাষাবাদ সম্ভব হয়। একারণে চাওয়াই ও এ অঞ্চলের জনগণের জীবন একে অপরের পরিপূরক। অথচ গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থান্বেষী কার্যক্রমে নদীটি ধ্বংসের মুখোমুখি। এ অঞ্চলের প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে চাওয়াই এর ওপর নির্ভরশীল। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়াতে নলকূপের পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটছে এবং নদীপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে পড়ছে জনজীবন। এই অবহেলা এ অঞ্চলের কৃষিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা ও নির্মল পরিবেশ প্রাপ্তিতে চাওয়াই নদী রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি হয়ে গেছে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট