কৃচ্ছ্রসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে
এমএ হোসাইন
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যে দেশ একসময় ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শ আর সামাজিক বাজার অর্থনীতির মডেল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরত, সেই জার্মানি আজ এক নতুন ও অশান্ত পর্বে প্রবেশ করছে। কয়েকদিন আগে চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ এমন এক ঘোষণা দিয়েছেন, যা জার্মানির যুদ্ধ-পরবর্তী সামাজিক চুক্তি থেকে এক মৌলিক বিচ্যুতি দেখা যায়। তিনি অকপটে বলেন, ‘আমরা অর্থনীতিতে যা উৎপাদন করি, তা দিয়ে আর আজকের কল্যাণ রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’
এধরনের বক্তব্য কখনও জার্মান রাজনীতির প্রচলিত ভঙ্গি ছিল না। সাধারণত নেতারা যেখানে কঠিন সত্যকে সবসময় আমলাতান্ত্রিক ভাষায় আড়াল করে থাকেন। কিন্তু মের্জ সরাসরি আঘাত করেছেন মূল জায়গায় (পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা, বেকার ভাতা, আবাসন সুবিধা), যারফলে জার্মান সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল স্তম্ভগুলো এখন আর টেকসই নয়। কেন এখন? কারণ জার্মানি বিপুল ব্যয়বহুল সামরিক পুনর্গঠন কর্মসূচি ও ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। সরকার জনসমর্থন আদায় না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক খাতে কাটছাঁটের ঘোষণা বিলম্বিত রেখেছিল। এখন প্রতিরক্ষায় বিলিয়ন ইউরো ঢালা হচ্ছে, আর কল্যাণ খাতকে নীরবে সংকুচিত করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিম জার্মানির নেতা কনরাড আদেনাউয়ার ও লুডভিগ এরহার্ড যে সামাজিক বাজার অর্থনীতির ধারণা গড়ে তুলেছিলেন, সেটি ছিল পুঁজিবাদ ও শক্তিশালী কল্যাণ রাষ্ট্রের মিশ্রন। এর লক্ষ্য ছিল সমৃদ্ধিকে সব শ্রেণির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া। এটি শুধু অর্থনৈতিক নীতি নয়, ছিল এক নৈতিক প্রতিশ্রুতি- ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ দুটোর বিরুদ্ধেই এক প্রতিরোধ।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজ পশ্চাদপসরণ করছে। জার্মানির আইনগত স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থা, যা একসময় স্বচ্ছল ছিল, এখন ঋণসাগরে নিমজ্জিত। ২০২৩ সালে ১.৯ বিলিয়ন ইউরোর ঘাটতি ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.২ বিলিয়ন ইউরোতে। অনুমান করা হচ্ছে- ২০২৫ সালে তা পৌঁছাবে ২৭ বিলিয়ন ইউরোয়। শ্রমিকদের অবদান হু হু করে বাড়ছে- কখনও কখনও আয়ের ৪ শতাংশেরও বেশি- যেখানে মুদ্রাস্ফীতি আবার ক্রয়ক্ষমতা ক্ষয়ে দিচ্ছে। কয়েক দশকের স্থিতিশীলতার পর পেনশন তহবিলও শুকিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ২ বিলিয়ন ইউরোর ঘাটতি ২০২৫ সালে তিনগুণ হতে পারে, আর ২০২৭ সালের মধ্যে রিজার্ভ ফুরিয়ে যাবে।
এটি শুধু অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি এক রাজনৈতিক ভূমিকম্প। জার্মানির বয়স্ক জনগোষ্ঠী (যাদের পাঁচজনের একজন দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে) তাদের বলা হচ্ছে আরও কৃচ্ছসাধন করতে। এক কোটি অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক মাসে ১,১০০ ইউরোর কম আয় করেন, যা দারিদ্র্যসীমার নিচে। অথচ সরকার ধনীদের কিংবা কর্পোরেটদের উপর নতুন কর আরোপে রাজি নয়। বরং উল্টো ‘বেবি বুমার সংহতি সারচার্জ’ নামের এক প্রস্তাবের কথা শুনা যাচ্ছে, যেখানে যারা সামান্য ব্যক্তিগত সঞ্চয় করেছেন, তাদের ভাতা কমিয়ে দেওয়া হবে যারা সঞ্চয় করতে পারেননি তাদের সাহায্যার্থে। বেসরকারীকরণের ফলে ব্যক্তিগত লাভবান হবে একশ্রেণি, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামাজিকীকরণ।
মের্জের ঘোষণার অল্প পরেই প্রতীকীভাবে অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার হঠাৎ কিয়েভ সফরে গিয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আরও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। বার্তাটি পরিষ্কার : ইউক্রেনকে টিকিয়ে রাখতে জার্মানি তার সামাজিক কল্যাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।
এমন নজির ইতিহাসে আগেও দেখা গেছে। আধুনিক ইতিহাসে যুদ্ধকালীন সময়ে বহু দেশই সামরিক ব্যয়ের জন্য সামাজিক খাত থেকে সম্পদ সরিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন দেশীয় ভোগ্য ব্যয় কেটে যুদ্ধ তহবিল জুগিয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ‘গানস অ্যান্ড বাটার’ নীতিতে যুদ্ধ ও কল্যাণ দুটো একসঙ্গে চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু শেষমেষ মুদ্রাস্ফীতি ও অস্থিরতার মুখে পড়ে। জার্মানি এখন ‘গানস ওভার বাটার’ - রুটি নয়, কামান বেছে নিচ্ছে।
তবে জার্মানির পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্রিটেন ১৯৪০-এ কিংবা ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জার্মানি সরাসরি যুদ্ধে নেই। ইউক্রেনকে সমর্থনকে তারা নৈতিক ও কৌশলগত দায়িত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করছে। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপের নিরাপত্তা রক্ষার অঙ্গীকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই খরচ বহন করছে না অভিজাত বা প্রতিরক্ষা শিল্প, বরং সাধারণ নাগরিকরা, বিশেষ করে দুর্বলরা।
বর্তমান শাসক জোট এই নতুন বাস্তবতায় টালমাটাল। উপ-চ্যান্সেলর লার্স ক্লিংবাইল (এসপিডি) দৃঢ়ভাবে বলছেন, উচ্চ আয়ের উপর কর বাড়ানো অবশ্যই বিকল্প হিসেবে থাকতে হবে- যা মের্জের অবস্থানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এসপিডির তরুণ নেতারাও সতর্ক করছেন, শুধু ভাতা কেটে নেওয়া জনগণের জন্য অসহনীয় হবে। তবু তারাও স্বীকার করছেন, সংস্কার এড়ানো যাবে না। এখন বিতর্ক হচ্ছে কাটছাঁট হবে কি না সেটা নয়, কতটা গভীর হবে তা নিয়ে। এতে উন্মোচিত হচ্ছে আরও গভীর সত্য; ১৯৪৫-এর পর যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙে পড়ছে। কল্যাণ রাষ্ট্র কেবল অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টন ছিল না, বরং ছিল জার্মানির পরিচয়ের অংশ- অতীতের নৃশংসতার নৈতিক সংশোধন। এখন সেই পরিচয় শূন্য হয়ে যাচ্ছে, জায়গা নিচ্ছে কৃচ্ছ্রতাসাধন ও সামরিকীকরণ। অর্থনৈতিক সূচকগুলোও ভয়ঙ্কর। মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মুদ্রাস্ফীতি বহু বছর ধরে বেশি। রাশিয়ান গ্যাস থেকে তড়িঘড়ি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর জ্বালানির দাম অস্থির। জার্মানির শিল্প উৎপাদনে ধীরগতি, খ্যাতনামা গাড়ি শিল্প বিদ্যুৎচালিত রূপান্তর ব্যয় ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় চাপে মধ্যে রয়েছে। ফলে কর রাজস্ব কমছে, ঘাটতি বাড়ছে, ঋণ দায়ভার বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা খরচ আকাশচুম্বী। বার্লিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ন্যাটোর জিডিপির ২ শতাংশ লক্ষ্য পূরণের, আর পুনঃসশস্ত্রকরণের জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রেখেছে। এই অর্থ নতুন কর থেকে নয়, কল্যাণ খাতের কাটছাঁট থেকেই আসছে। এটি শুধু বাজেট সমন্বয় নয়; এটি মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন যেখানে সামাজিক নিরাপত্তার চেয়ে সামরিক প্রস্তুতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। জার্মানি এর আগেও এ পথে হেঁটেছিল। মহামন্দার সময় চ্যান্সেলর হাইনরিখ ব্রুনিং-এর কৃচ্ছসাধন ব্যবস্থা সামাজিক দুর্দশা তীব্র করে তোলে এবং হিটলারের উত্থানকে সহজতর করে। অবশ্যই আজকের জার্মানি সেই ওয়াইমার নয়, এখন প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক শক্তিশালী, গণতন্ত্র স্থিতিশীল। কিন্তু রাজনৈতিক শিক্ষা স্পষ্ট: অবিচারপূর্ণ কৃচ্ছসাধন জনগণের আস্থা নষ্ট করে ও চরমপন্থার জন্ম দেয়। এর মধ্যেই ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফার ডয়েচল্যান্ড জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, বিশেষত পূর্ব জার্মানিতে। তাদের বার্তা সহজ: বিদেশি যুদ্ধ অর্থায়ন বন্ধ করো, অভ্যন্তরীণ কল্যাণ ফিরিয়ে দাও, জার্মানদের গুরুত্ব সবার আগে রাখো। যখন মূলধারার দলগুলো এমন নীতি নেয় যা সাধারণ নাগরিককে আরও বিপন্ন করে, তখন চরমপন্থার উত্থান অনিবার্য হয়ে উঠে। সরকার বলছে, ইউক্রেনকে সহায়তা করা গণতন্ত্র রক্ষার নৈতিক দায়। এই যুক্তির ভিত্তি আছে। রাশিয়ার জয় ইউরোপকে অস্থির করবে এবং অন্যান্য স্বৈরশাসক শক্তিকে সাহসী করবে। কিন্তু নৈতিকতা ভাগ করা যায় না: বাইরে গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে ঘরে সামাজিক স্থিতি ভেঙে দেয়ার কোন মানেই হয় না। বৃহত্তর ঝুঁকি হলো- জার্মানি যদি ভূরাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে অভ্যন্তরীণ কল্যাণের উপর অগ্রাধিকার দেয়, তবে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বিসর্জন দিয়ে সাময়িক ন্যাটো-ওয়াশিংটনের সামঞ্জস্যকেই বেছে নিচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক
