জনকল্যাণমুখী পুলিশব্যবস্থা : একটি রূপরেখা

একেএম মতিনুর রহমান

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আধুনিক সভ্য ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ বাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। তাছাড়াও একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। পুলিশ শুধু অপরাধ দমনকারী একটি বাহিনী নয়, বরং জনগণের বন্ধু এবং সেবক হিসাবেও তাদের কাজ করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের পুলিশব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে দীর্ঘকাল নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ বিদ্যমান। এ ব্যবস্থা এখনো ব্রিটিশ আমলের পুরোনো আইন এবং ধ্যান-ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়ে আসছে, যা আধুনিক সমাজের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি এবং অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে জনগণের সেবক না ভেবে শাসক হিসাবে দেখা হয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পুলিশব্যবস্থার আমূল সংস্কার এবং আধুনিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। এ ভাবনাকে মাথায় রেখে একটি রূপরেখা উপস্থাপন করছি। এখানে আমরা এ তিনটি প্রধান ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং দেখাব কীভাবে এগুলোকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থানীয় পুলিশব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং জনকল্যাণমুখী পুলিশি সেবা নিশ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশের স্থানীয় পুলিশব্যবস্থাকে আধুনিক এবং জনবান্ধব করে তুলতে প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ অপরিহার্য। পুরোনো আমলের সনাতনী পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের একটি নতুন দিগন্তের দিকে অগ্রসর হতে হবে, যেখানে প্রযুক্তি হবে পুলিশের প্রধান সহায়ক। এর প্রথম ধাপ হলো প্রতিটি থানাকে তথ্যপ্রযুক্তিসক্ষম করে গড়ে তোলা। একটি অনলাইন অভিযোগ পোর্টাল চালু করা হলে মানুষ তাদের ঘরে বসেই যে কোনো অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এতে করে থানায় গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। প্রতিটি অভিযোগের একটি ডিজিটাল রেকর্ড থাকবে, যা কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে এবং অভিযোগের অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যাবে। এটি শুধু সেবাকে সহজলভ্য করবে না, বরং অভিযোগের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

এছাড়াও টহলব্যবস্থায় প্রযুক্তি যুক্ত করা হলে সেটি আরও কার্যকর হয়ে উঠবে। জিপিএস ট্র্যাকিং ও ডেটা অ্যানালাইসিস ব্যবহার করে কোথায় এবং কখন টহল দেওয়া প্রয়োজন, তা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। ফলে অপ্রয়োজনীয় টহল কমিয়ে সংবেদনশীল এলাকায় নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, জনবহুল স্থান এবং সংবেদনশীল মোড়গুলোয় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়ানো উচিত।

এটি অপরাধ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত করা সহজ হবে। পাশাপাশি অপরাধের বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের জন্য স্থানীয় পুলিশ ইউনিটগুলোয় আধুনিক ফরেনসিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা এবং পুলিশ সদস্যদের এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। এতে করে অপরাধের সঠিক কারণ নির্ণয় এবং প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে, যা দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো সম্মিলিতভাবে পুলিশকে আরও দক্ষ, কার্যকর এবং জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম দেবে।

জনকল্যাণমুখী সেবা : পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থা স্থাপন পুলিশের মূল কাজ শুধু অপরাধ দমন করা নয়, বরং জনগণের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। এ লক্ষ্যে জনকল্যাণমুখী সেবার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কমিউনিটি পুলিশিংব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিয়মিত কমিউনিটি মিটিং আয়োজন করে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, যেখানে পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং জনগণ একসঙ্গে কাজ করবে। এ ধরনের পারস্পরিক আলোচনা শুধু সমস্যা সমাধানেই সাহায্য করবে না, বরং পুলিশ সম্পর্কে জনগণের ভুল ধারণা দূর করবে, তাদের মধ্যে আস্থা বাড়াবে।

পুলিশ সদস্যদের জন্য মানবিক আচরণ ও সংবেদনশীলতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। বিশেষ করে নারী, শিশু এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের ওপর জোর দেওয়া উচিত। এটি পুলিশের ভাবমূর্তি উন্নত করবে এবং তাদের প্রতি জনগণের ভয় কমিয়ে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করবে। থানায় আসা মানুষের জন্য জনবান্ধব একটি হেল্প ডেস্ক চালু করা হলে তারা সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহায়তা পাবে। এ হেল্প ডেস্কের কর্মীরা মানুষের সমস্যাগুলো শুনে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। সেবার মানোন্নয়নের জন্য একটি অনলাইন ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করা যেতে পারে, যেখানে মানুষ পুলিশের সেবার মান নিয়ে তাদের মতামত জানাতে পারবে। এ মতামতগুলো বিশ্লেষণ করে পুলিশ তাদের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারবে এবং সেবার মান উন্নত করতে পারবে। একটি পুলিশবাহিনী তখনই সফল হবে, যখন তারা শুধু আইনপ্রয়োগকারী হিসাবে নয়, বরং জনগণের বন্ধু হিসাবে কাজ করবে।

প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার : একটি শক্তিশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাহিনী গঠন একটি আধুনিক এবং জনবান্ধব পুলিশবাহিনীর জন্য প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। এ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি শক্তিশালী, দক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত বাহিনী গঠন করা। এর প্রথম ধাপ হলো নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি কঠোর এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে পেশাদার এবং মেধাবী ব্যক্তিরা পুলিশবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী হবে। একইভাবে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।

ভেতরের এবং বাইরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। যদি কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে তার দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করে কঠোর শান্তিমূলক ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে। এতে অন্যদের কাছে একটি বার্তা যাবে, কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ সহ্য করা হবে না। প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের কর্মদক্ষতার নিয়মিত মূল্যায়ন হওয়া দরকার এবং তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও পুলিশ সদস্যদের কাজের ঝুঁকি বিবেচনা করে তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতে তারা আরও বেশি উৎসাহিত হবে এবং দুর্নীতির প্রবণতা কমবে। এ ধরনের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে পুলিশবাহিনী আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবে। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই উন্নত করবে না, বরং একটি সুশৃঙ্খল এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের পুলিশব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও জনকল্যাণমুখী করার জন্য এ রূপরেখাটি একটি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের পথ দেখায়। প্রযুক্তি, মানবিক সম্পর্ক এবং প্রশাসনিক সংস্কারের এ সমন্বিত প্রচেষ্টা শুধু পুলিশের কার্যকারিতাই বাড়াবে না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একটি আধুনিক পুলিশবাহিনী শুধু অপরাধ দমন করবে না, বরং জনগণের সুরক্ষা এবং আস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। এ পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়িত হলে পুলিশ তাদের পুরোনো ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবক হিসাবে পরিণত হবে।

তবে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ কেবল পুলিশের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। সরকার, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকেও এ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। তাছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ফ্যাসিবাদী শাসনামলে পুলিশবাহিনীর অতি উৎসাহী সদস্যর জনগণের বিপক্ষে আগ্রাসি ভূমিকার কারণে তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসাবে পুলিশবাহিনীকে উত্তরণ ঘটানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং একটি উন্নত ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রায় পুলিশকে জনগণের পাশে থেকে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব।

লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া