বাংলাদেশে মাশরুম কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না

ড. মো. আজিজুর রহমান

প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাদ্য। এটি শুধু খাদ্যগুণে পরিপূর্ণ নয়, এর রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও রোগ সারানোর ক্ষমতা। প্রোটিনের উৎস হিসেবে আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস, ডাল এসব বেশ জনপ্রিয় হলেও প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি মাশরুম আমাদের খাদ্য তালিকায় অবহেলিত থেকে গেছে।

মাশরুম ব্যবহারের ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও চীনে মাশরুমের ব্যবহার ছিল। ফারাও সম্রাটদের রাজকীয় ভোজে মাশরুম থাকত, তবে তা সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। প্রাচীন চীন ও গ্রিসে মাশরুমকে বলা হতো ‘ঈশ্বরের খাদ্য’ (foods of the Gods)। চীনারা প্রাচীনকাল থেকে গ্যানোডার্মা লুসিডাম (Ganoderma lucidum) বা লিংজি বা রেইশি মাশরুমকে জীবনীশক্তি বৃদ্ধি, দীর্ঘায়ু, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক প্রশান্তির জন্য ব্যবহার করে আসছে।

প্রাচীন সভ্যতায় মাশরুম শুধুমাত্র ধর্মীয় ও ঔষধি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যুগের পরিক্রমায় এখন মাশরুম অনেক দেশের মূল খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং এর বহুবিধ উপকারিতা ও পুষ্টিগুণের কারণে এটি সুপারফুডের মর্যাদা পেয়েছে। মাশরুম শুধু খাদ্য নয়, এটি হয়ে উঠেছে ওষুধের বিভিন্ন উপাদানেরও উৎস।

মাশরুম আসলে কী? : অনেকে মাশরুমকে এক প্রকারের উদ্ভিদ মনে করলেও এটি উদ্ভিদ নয়, এটি বড় আকারের ছত্রাক যা ফ্রুটিং বডি তৈরি করতে পারে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মাশরুমের ১৪,০০০ প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩,০০০ প্রজাতি খাওয়ার উপযুক্ত এবং প্রায় ৩০টি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়।

ব্যবহার ও বিষাক্ততার বিবেচনায় মাশরুমের প্রজাতিগুলো চার ভাগে ভাগ করা হয়­-

১. খাওয়ার উপযোগী মাশরুম (যেমন-বাটন, ওয়েস্টার, ইনোকি, কান মাশরুম ইত্যাদি)। ২. ঔষধি মাশরুম (গ্যানোডার্মা বা রেইশি, টার্কি টেইল, লাইওন মেইন মাশরুম ইত্যাদি)। ৩. বিষাক্ত মাশরুম (যেমন ডেথ ক্যাপ বা Amanita phalloides) এবং

৪. অন্যান্য মাশরুম যেগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তেমন জানা যায়নি।

কিছু মাশরুম রান্না করে খাওয়ার উপযোগী এবং একইসঙ্গে সেগুলোর শক্তিশালী ঔষধি গুণাবলিও রয়েছে, যেমন শিতাকে (Shiitake), ওয়েস্টার বা ঝিনুক (Oyster) ইত্যাদি। কিছু ঔষধি মাশরুম যেমন রেইশি বা লিংজি (Ganoderma lucidum), টার্কি টেইল (Trametes versicolor) ইত্যাদি শুধু ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এগুলো শক্ত হওয়ায় রান্না উপযোগী নয়, তাই এগুলো গুড়া করে করে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আকারে অথবা গরম পানি বা অন্যান্য দ্রাবকের সাহায্যে নির্যাস বের করে সে নির্যাস বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। মাশরুমের নির্যাস এখন বিভিন্ন কসমেটিকসেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

মাশরুমের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার কোন দেশে কেমন? : সারা বিশ্বের মধ্যে মাশরুম উৎপাদন, গবেষণা ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহারে চীন সবচেয়ে অগ্রগণ্য। ২০২৩ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে চীনে মাথাপিছু মাশরুম ভক্ষণের পরিমাণ বছরে প্রায় ৩০ কেজি। চীনে শিতাকে, ইনোকি, ওয়েস্টার বা ঝিনুক, বাটন, কান এবং কিং ওয়েস্টার মাশরুম খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে ব্যবহৃত হয়। ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনে মাশরুমের ব্যবহার ব্যাপক। চাইনিজ মেডিসিনে মাশরুমকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, দীর্ঘায়ু ও শক্তি বৃদ্ধি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (ফুসফুস, হৃদপি-, কিডনি, লিভার) সুরক্ষা, সৌন্দর্য ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। চীনে ঔষধি মাশরুমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় Ganoderma lucidum (লিংজি বা রেইশি) যেটি চাইনিজরা ‘অমরত্বের মাশরুম’ বা Mushroom of Longevity বলে থাকে। গ্যানোডার্মা মাশরুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং হৃদযন্ত্র সুরক্ষা করে। এটির ক্যান্সার প্রতিরোধী ক্ষমতাও রয়েছে। বাংলাদেশে এখন গ্যানোডার্মা মাশরুমের কয়েকটি জাত বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয়।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীনের পরে মাশরুম খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় জাপান, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে। জাপানেও মাশরুম নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়। জাপানিজরা সবচেয়ে বেশি খেয়ে থাকে শিতাকে, ইনোকি, মাইতাকে ও মাতসুতাকে মাশরুম। জাপানিজরা গড়ে বছরে প্রায় চার কেজি মাশরুম খায়। অনেকে মাশরুমকে এক প্রকারের উদ্ভিদ মনে করলেও এটি উদ্ভিদ নয়, এটি বড় আকারের ছত্রাক যা ফ্রুটিং বডি তৈরি করতে পারে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মাশরুমের ১৪,০০০ প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩,০০০ প্রজাতি খাওয়ার উপযুক্ত এবং প্রায় ৩০টি প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মাশরুম খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের দিকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেদারল্যান্ডস। ডাচরা গড়ে বছরে প্রায় ১৫ কেজি মাশরুম খেয়ে থাকে। ডাচদের মধ্যে বাটন, শিতাকে ও ওয়েস্টার মাশরুম সবচেয়ে জনপ্রিয়। ডাচরা বন জঙ্গল থেকেও প্রচুর বন্য মাশরুম সংগ্রহ করে। ডাচদের পরে ইউরোপে মাশরুমের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ইতালি, ফ্রান্স, পোল্যান্ডে।

যুক্তরাষ্ট্রে মাশরুমের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বছরে গড়ে ১.৫ কেজি মাশরুম খায়। তাদের কাছে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বাটন, শিতাকে, ওয়েস্টার ও লায়ন্স মেইন (Lion’s mane) মাশরুম। দক্ষিণ এশিয়ায় মাশরুমের ব্যবহার সবচেয়ে কম। ভারতীয়রা গড়ে মাত্র ৪০ গ্রাম মাশরুম খেয়ে থাকে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালেও মাশরুম খাদ্য হিসেবে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য হিসেবে বাটন, শিতাকে, ওয়েস্টার মাশরুম বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে ওয়েস্টার এবং বাটন মাশরুমের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে।

বিশ্বে মাশরুমের মার্কেট কত বড়? বাংলাদেশের অবদান কতটুকু?

বিশ্বে মাশরুমের বাজার বেশ বড়। সব মিলিয়ে মাশরুমের মোট বাজার প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। মাশরুমের বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০ শতাংশ। মাশরুমের মোট বিক্রির প্রায় ৫০ শতাংশ বাটন মাশরুম, ২০ শতাংশ ওয়েস্টার মাশরুম, ২০ শতাংশ শিতাকে এবং ৭ শতাংশ গ্যানোডার্মা বা রেইশি মাশরুম, বাকি অংশ অন্যান্য মাশরুম। মাশরুম ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মাশরুমের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার। প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন মাশরুম উৎপাদিত হয়। দেশের প্রায় এক লাখ কৃষক মাশরুম উৎপাদনের সাথে জড়িত।

মাশরুমকে কেন ‘সুপারফুড’ বলা হয়?

মাশরুম ইতিমধ্যে সুপারফুডের মর্যাদা পেয়েছে। কারণ, ভক্ষণযোগ্য মাশরুম উচ্চ পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং মাশরুমে একই সঙ্গে খাদ্য, ঔষধি ও প্রতিরোধমূলক জৈব উপাদানের উপস্থিতি থাকে। মাশরুমে ক্যালোরি কম থাকে; কিন্তু উচ্চ মাত্রার প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স (ই২, ই৩, ই৫, ই১২), ভিটামিন ডি এবং মিনারেল, যেমন পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়রন, কপার ও জিংক রয়েছে।

মাশরুমে ফ্যাট ও কোলেস্টেরল প্রায় নেই বললেই চলে। মাশরুমে অনেক বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ যেমন বেটা-গ্লুকান, ট্রাইটারপেনয়েড, পলিস্যাকারাইড, ফেনলিক যৌগ এবং আরগোথায়োনিন থাকে। যেগুলো বিভিন্ন রোগ (যেমন হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার) প্রতিরোধ করে। ওয়েস্টার মাশরুম থাকা বেটা-গ্লুকান ও লোভাস্ট্যাটিন নামক যৌগসমূহ রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমাতে সাহায্য করে।

সূর্যের আলোতে যেসব মাশরুম জন্মায় তাতে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে। অবশ্য, ছায়ায় চাষ করা মাশরুমকে আলট্রাভায়োলেট লাইট ট্রিটমেন্ট করেও ভিটামিন ডি-এর পরিমাণ বাড়ানো যায়। এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আমরা একটি গবেষণা সম্পন্ন করি। গবেষণার ফলাফল বলছে, বাংলাদেশে মাশরুম জনপ্রিয় না হওয়ার মূল কারণগুলো হলো- বাজারে খাদ্য উপযোগী তাজা মাশরুম না পাওয়া, বেশি দাম, মাশরুম খেতে ভয় পাওয়া, রান্নার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং পরিবারের সদস্যদের মাশরুম খেতে আপত্তি।

আমরা গবেষণার অংশ হিসেবে কয়েকজন মাশরুম চাষির সঙ্গে কথা বলেছি। একজন চাষি বলেছেন, তিনি যে পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করেন তার পুরোটাই দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। অনেকে প্রি-অর্ডার দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও স্ট্রিট ফুড শপগুলোয় মাশরুমের চাহিদা ব্যাপক। বাংলাদেশের আবহাওয়া ওয়েস্টার, মিল্কি হোয়াইট ও স্ট্র মাশরুম উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এ মাশরুমগুলোর মধ্যে ওয়েস্টার মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং ঔষধি গুণে ভরপুর। এটি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সারা বছর চাষ করা যায়, দ্রুত বর্ধনশীল এবং উৎপাদন খরচ অনেক কম।

বাংলাদেশে ওয়েস্টার মাশরুমের চাষও হচ্ছে অনেক। এর বেশিরভাগ ব্যবহৃত হয় রেস্টুরেন্টে। কাঁচা মাশরুম সুপারমার্কেটে বা কাঁচা বাজারে পাওয়া যায় না, তাই মানুষ চাইলেও ফ্রেশ মাশরুম কিনতে পারে না। গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা রাজশাহীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ও সুপারমার্কেট সার্ভে করেছি। কোথাও ফ্রেশ মাশরুম বিক্রি করতে দেখা যায়নি। তবে, অনলাইনে বা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে খামারিদের কাছ থেকে সরাসরি ফ্রেশ মাশরুম কিনে পাওয়া যায়। আমাদের ‘মাশরুমের দাম বেশি’ এটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ওয়েস্টার মাশরুমের মতো আমাদের দেশে সহজে উৎপাদনযোগ্য অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাশরুম আমাদের দেশে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা কেজি, যেখানে এক কেজি খাসির মাংস প্রায় ১,১০০ টাকা। অথচ, ইংল্যান্ডে ওয়েস্টার মাশরুম প্রায় ১৮০০-২০০০ টাকা কেজি, এক কেজি খাসির মাংস ৫০০-৭০০ টাকা কেজি। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে মানুষ এক কেজি খাসির মাংসের পরিবর্তে তিন কেজি ওয়েস্টার মাশরুম কিনবে। কারণ, ওয়েস্টার মাশরুমের স্বাদ খাসির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আর পুষ্টিগুণে খাসির চেয়ে অনেক বেশি, স্বাস্থ্যঝুঁকিও কম।

অন্যদিকে, আমাদের দেশে বাটন মাশরুম উৎপাদন কিছুটা কঠিন কারণ এটি উৎপাদনের জন্য ঠান্ডা আবহাওয়া লাগে। তাই, আমাদের দেশে বাটন মাশরুমের দাম বেশি প্রায় ১,০০০ টাকা কেজি। শীতপ্রধান দেশে এটি উৎপাদন সহজ। সেসব দেশে বাটন মাশরুমের দাম সর্বোচ্চ ৪০০-৫০০ টাকা কেজি। মাশরুমে ক্যালোরি কম থাকে; কিন্তু উচ্চ মাত্রার প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স (ই২, ই৩, ই৫, ই১২), ভিটামিন ডি এবং মিনারেল, যেমন পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়রন, কপার ও জিংক রয়েছে। মাশরুমে ফ্যাট ও কোলেস্টেরল প্রায় নেই বললেই চলে। মাশরুম কীভাবে খেতে হবে, সেটি না জানা মাশরুম জনপ্রিয় না হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। মাশরুমকে জনপ্রিয় করতে হলে এটির রান্নার পদ্ধতি নিয়েও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

আর মাশরুম নিয়ে ভীতি তো আছেই। অনেক মানুষ এখনও মাশরুমকে ব্যাঙের ছাতা মনে করে। খেতে ভয় পায়। কোন মাশরুম বিষাক্ত আর কোনটি নিরাপদ তা নিয়ে সচেতনতা বাড়ালে মানুষের মাশরুমের নিরাপত্তা নিয়ে যে ভয় সেটি কাটিয়ে উঠবে।

ক্ষতিকর মাশরুম চেনার উপায় কী? সাভারে অবস্থিত মাশরুম ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট চীন ও জাপান থেকে বিভিন্ন সময়ে ওয়েস্টার, মিল্কি, গ্যানোডার্মাসহ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক মাশরুমের জাত সংগ্রহ করে তা দেশে কম খরচে উৎপাদনের পদ্ধতি বের করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে। এর ফলে আমাদের দেশে যেসব মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় তা নিরাপদ ও উন্নত জাতের। কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানিও উন্নতমানের মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে, যার মধ্যে Panbo Bangla Mushroom Ltd. (PBML), Mushroom Bangla অন্যতম। যারা বনজঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে মাশরুম খেতে আগ্রহী তাদের ক্ষতিকর মাশরুম চেনা জরুরি। ক্ষতিকর মাশরুম সাধারণত উজ্জ্বল লাল, কমলা বা হলুদ টুপিওয়ালা হয়ে। Amanita-গণের মাশরুমগুলো সাধারণত বিষাক্ত হয়ে থাকে। মাশরুমের টুপিতে সাদা বা বাদামি দাগ থাকলেও সেটি বিষাক্ত হতে পারে। বিষাক্ত মাশরুমে প্রায়ই তীব্র, বাজে গন্ধ থাকে। খাবার উপযোগী মাশরুমে সাধারণত হালকা বা মাটির মতো গন্ধ থাকে। অনেক মারাত্মক বিষাক্ত প্রজাতি (যেমন Amanita phalloides ev death cap)-এর ডাঁটার গোঁড়ায় থলে-সদৃশ ভলভা এবং ডাঁটার মাঝখানে রিং থাকে। অনেক ক্ষতিকর মাশরুম কাটলে বা ভাঙলে রঙ পরিবর্তন করে (যেমন নীলচে বা লালচে হয়ে যায়)।

মাশরুম চাষ যেহেতু পরিবেশবান্ধব, কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না, অল্প যায়গায় উল্লম্ব পদ্ধতিতে চাষ করা যায় এবং কৃষির আবর্জনা- যেমন খড়, তুষ এবং কাঠের গুড়া দিয়ে সহজেই আবাদ করা যায়, তাই, এটি হতে পারে একটি টেকসই কৃষির অন্যতম স্তম্ভ। আর যেসব কারণে আমাদের দেশে মাশরুম জনপ্রিয় হচ্ছে না তা সমাধান করা কঠিন নয়। মাশরুম চাষের সম্প্রসারণ ঘটলে এবং গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ উৎপাদনশীল জাত আবিষ্কার করতে পারলে, বাজারে মাশরুমের প্রাপ্তি বাড়বে। চিকিৎসায় মাশরুমের ব্যবহার বাড়াতে হবে, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ঔষধি মাশরুম উৎপাদনে জোড় দিতে হবে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সহজে উৎপাদনযোগ্য ঔষধি মাশরুম যেমন গ্যানোডার্মার উৎপাদন বাড়িয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। দেশে মাশরুমকে জনপ্রিয় করতে পারলে মাধ্যমে যেমন একদিকে মানুষ কম খরচে উন্নতমানের প্রোটিন ও ভিটামিনের উৎস পাবে, তেমনি মাশরুমের রোগ প্রতিরোধ গুণাবলির কারণে এটি মানুষকে সুস্থ রাখবে। বেকারত্ব দমনেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তাই, সরকারের উচিত মাশরুমের জাত উন্নয়নে গবেষণাকে উদ্বুদ্ধ করা এবং মাশরুমকে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা। মাশরুম হয়ে উঠুক প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের নিরাপদ উৎস।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়