গর্ভবতী নারীদের জীবন ঝুঁকিতে

জেসমিন চৌধুরী

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মাতৃত্ব মানবসভ্যতার সর্বাধিক পবিত্র ও দুর্লভ অভিজ্ঞতা। গর্ভধারণ শুধু একটি জৈব-প্রকৃতির প্রক্রিয়া নয়, বরং জীবনযাত্রার অব্যাহত ধারাবাহিকতার অন্যতম অনিবার্য উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে গর্ভবতী নারীর জীবন যেন নিয়ত দুঃখবেদনাময় সংগ্রামের প্রতীক। বিশেষত দারিদ্র?্যপীড়িত, প্রান্তিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত নারীদের মাতৃত্ব একদিকে যেমন অবর্ণনীয় ত্যাগের প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে তেমনি তা রূপান্তরিত হয়েছে অনাবিল যন্ত্রণার প্রতীকীতে।

আমাদের জাতীয় বাস্তবতায় গরিব ও অসহায় গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র এক গভীর সংকটের নামান্তর। পুষ্টির মারাত্মক ঘাটতি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রাপ্যতা, চিকিৎসা-সুবিধার অপ্রতুলতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক মানসিকতা, পারিবারিক অবহেলা এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা- সবকিছু মিলিত হয়ে তাঁদের জীবনকে মৃত্যুভয়ের শীতল অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। অথচ এই নারীরাই আগামী দিনের নাগরিককে পৃথিবীর আলো দেখাবেন। অর্থাৎ, তাঁদের অনিরাপদ মাতৃত্ব মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা।

দারিদ্র নামক অদৃশ্য শৃঙ্খল তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যেন অমোঘ বিধিনিষেধের মতো উপস্থিত। ভোর থেকে গভীর রজনী পর্যন্ত দিনমজুরের স্ত্রী, রিকশাচালকের জীবনসঙ্গিনী কিংবা শহরের বস্তিবাসী গার্মেন্টসকর্মী নারী- প্রত্যেকেই সংসারের ভার বহন করতে গিয়ে গর্ভাবস্থার প্রয়োজনীয় যত্ন থেকে বঞ্চিত হন। খাবারের টেবিলে পর্যাপ্ত আহারই যখন অনুপস্থিত, তখন গর্ভধারণকৃত মায়ের জন্য বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্য সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব। তাঁদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা সীমাবদ্ধ থাকে ভাত, আলু, ডাল কিংবা সামান্য শাকসবজিতে। দুধ, ডিম, মাছ কিংবা মাংস তাঁদের কাছে দুর্লভ স্বপ্নমাত্র। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে- গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীর দ্বিগুণ পুষ্টি চাহিদা অনুভব করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁরা পুষ্টির অভাবে রক্তশূন্যতায় ভোগেন এবং প্রসবকালে সামান্য রক্তক্ষরণই তাঁদের জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থা আরও শোচনীয়। গ্রামীণ অঞ্চলে কিংবা শহরের প্রান্তিক এলাকায় বসবাসকারী নারীরা চিকিৎসা সেবার নাগাল পান না। একজন গর্ভবতী নারীর অন্তত চারবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। কিন্তু অর্থাভাবে, দূরত্বের কারণে কিংবা চিকিৎসাকেন্দ্রের অপ্রতুলতার দরুন তাঁরা তা করতে পারেন না। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেও চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন, ওষুধ থাকে না, প্রশিক্ষিত ধাত্রীও পাওয়া যায় না। ফলে তাঁদের নির্ভর করতে হয় অদক্ষ ধাত্রী বা কবিরাজের ওপর, যা প্রসবকালীন জটিলতার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

এখানেই শেষ নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে আরও প্রকট করে তোলে। বহু পরিবারে এখনো প্রচলিত রয়েছে, গর্ভবতী নারী বেশি খেলে সন্তান অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়, ফলে প্রসবে বিপদ ঘটে। এমন অযৌক্তিক বিশ্বাসের ফলে তাঁদের খাদ্য গ্রহণ সীমিত করা হয়। আবার অনেক পরিবারে ধারণা, হাসপাতালে প্রসব করানো মানেই অযথা খরচা, তাই গৃহেই অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করানো হয়। এইসব প্রথাগত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারণে অজস্র নারী প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, অথচ তা প্রতিরোধযোগ্য ছিল।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনো উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি লাখে প্রায় ১৬৫ জন মা প্রসবজনিত জটিলতায় প্রাণ হারান। এর মধ্যে গরিব ও অসহায় শ্রেণির নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ হলো- রক্তশূন্যতা, ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব, চিকিৎসকের অনুপস্থিতি ও দারিদ্র?্যজনিত সীমাবদ্ধতা। এ যেন রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক সত্য।

গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিও অত্যন্ত প্রকট। দারিদ্র?্যরে সঙ্গে লড়াই করতে করতে, স্বামীর অবহেলা ও পারিবারিক সহিংসতা সহ্য করতে করতে তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। গর্ভকালীন সময়ে হরমোনের পরিবর্তনজনিত কারণে বিষণ্ণতা তাঁদের গ্রাস করে। পরবর্তীতে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতাও তাঁদের মানসিক সুস্থতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে সচেতনতা নেই বললেই চলে।

এখন প্রশ্ন হলো- রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁদের জন্য কী করছে? সরকারি বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ অপ্রতুল। অনেক সময় আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও তা টেকসই হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত থেকে যান। ফলে গরিব ও অসহায় নারীরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। সমাধান স্পষ্ট। প্রথমত, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, সেখানে চিকিৎসক ও ধাত্রী নিয়োগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিনামূল্যে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড ট্যাবলেট ও প্রয়োজনীয় টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, দারিদ্র?্যসীমার নিচে থাকা মায়েদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা যেতে পারে, যাতে তাঁরা ন্যূনতম পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারেন। চতুর্থত, সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে হবে- সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পঞ্চমত, এনজিও, মিডিয়া ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : লেখিকা, জিন্দাবাজার, সিলেট