জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপদ পানির সংকট

মোছা. শাকিলা খাতুন

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের জীবনধারণের জন্য যে কয়টি উপাদান অপরিহার্য, তার মধ্যে অন্যতম হলো পানি। পানি ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। মানুষ খাদ্য ছাড়া কিছুদিন টিকে থাকতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই যুগে যুগে বলা হয়েছে, পানির অন্য নাম জীবন। কিন্তু এই জীবনদায়ী উপাদান আজ ভয়াবহ সংকটে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার করছে। যে পৃথিবী একসময় নদী, হ্রদ, খাল-বিল আর ঝরনার প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল, আজ সেখানে পানির সংকট মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রসার, নদী-নালা ভরাট, দখল ও দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা- সব মিলিয়ে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। আর বাংলাদেশ এই সংকট থেকে রেহাই পায়নি, বরং ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে আমাদের দেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহ। বর্তমানে বাংলাদেশে মাত্র ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় এসেছে। অন্যদিকে ৫৯ শতাংশ মানুষ এখনও অনিরাপদ পানি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের মতো একটি নদীমাতৃক দেশে এমন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে এক বড় ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে। যে দেশে একসময় পানির প্রাচুর্য ছিল, সেই দেশেই আজ নিরাপদ পানি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিষয়টি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ।

আমরা জানি, বাংলাদেশে পানির বেশির ভাগ চাহিদা মেটানো হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। প্রায় ৮০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যা খাবার পানি, রান্না, গোসল থেকে শুরু করে কৃষি ও সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর ফলাফল ভয়াবহ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে দেখা যায়, এখানে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে এক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সে হারে যদি চলতে থাকে, তবে একসময় গভীর নলকূপ থেকেও আর পানি উঠবে না।

পানির সংকট শুধু প্রাপ্যতার সংকট নয়, এটি গুণগত মানের সংকটও। অর্থাৎ যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তার বড় অংশই নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ডব্লিউএইচওর মানদ-ে দেশের প্রায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ পানির উৎসে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। গৃহস্থালি পর্যায়ে এই হার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে উৎসে আর্সেনিকের হার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হিসাবে অন্তত এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানির সংস্পর্শে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী এ সংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লাখ। এটি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এক সংকট। আর্সেনিক-দূষিত পানি যে মানবদেহে কতটা ক্ষতিকর তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি দীর্ঘমেয়াদে মানুষের শরীরে ক্যানসার, চর্মরোগ, লিভার-কিডনির জটিলতা তৈরি করে। গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষ যারা প্রতিদিন আর্সেনিক-যুক্ত পানি পান করতে বাধ্য হয়, তারা আসলে প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেবল আর্সেনিক নয়, লবণাক্ততাও বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ত পানির সমস্যা সীমিত ছিল, কিন্তু এখন এটি দেশের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফরিদপুর, রাজবাড়ীর মতো জেলাতেও লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে লবণাক্ত পানি আরও ভেতরের দিকে ঢুকে পড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বহু মানুষ প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছে। এ দৃশ্য আমাদের জন্য লজ্জার, কারণ এক নদীমাতৃক দেশে মানুষ যদি প্রতিদিন কলসি কাঁধে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনে, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে!

পানির সংকটের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি। কারণ কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ধান, গম, ভুট্টা, সবজিসহ সব ফসলের জন্য পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন। কিন্তু পানির সংকট যদি ক্রমেই বাড়তে থাকে, তবে খাদ্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়বে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন ও পানির সংকটের কারণে ধান ও ভুট্টার উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যাবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটি ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। একদিকে সুপেয় পানির সংকট, অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি- এই দুই সংকট মিলিয়ে আমাদের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপটও ভিন্ন নয়। এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশই মারাত্মক পানিসংকটে রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ সুপেয় পানির সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা, নদী দখল ও দূষণ- সব মিলিয়ে এশিয়ার এই অঞ্চল এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলসংকটের এলাকায় পরিণত হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, আগামী শতাব্দীতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হবে পানির জন্য। তেল বা গ্যাস নয়, বরং একটি গ্লাস পানি তখন সোনার চেয়েও মূল্যবান হয়ে উঠবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসব? প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। এভাবে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামতে থাকলে একসময় ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নগরায়ণের কারণে যেসব জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি শহরে বড় বড় জলাশয়, পুকুর, খাল তৈরি করতে হবে, যাতে সেগুলো বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত, নদী-নালা খনন করতে হবে। নদী দখলমুক্ত করতে হবে। নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। তৃতীয়ত, শিল্প ও কৃষিখাতে পানির অপচয় বন্ধ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প কারখানাগুলোতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, মানুষকে সচেতন করতে হবে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে অযথা পানি অপচয় করি, সেটি বন্ধ করতে হবে। পানির প্রতিটি ফোঁটার মূল্য আমাদের বুঝতে হবে।

এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহারও জরুরি। আর্সেনিক ও লবণাক্ততা দূর করতে আধুনিক ফিল্টার প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এখানে অত্যন্ত জরুরি। কারণ বাংলাদেশ একটি নিম্ন অববাহিকার দেশ। আমাদের নদীর উজান অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর হাতে। তাই সীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে ন্যায্য সমাধান করতে হবে। নদীর পানি কেবল এক দেশের সম্পদ নয়, এটি সবার। সবশেষে বলা যায়, পানির সংকট আজ শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। পানি ছাড়া জীবন নেই। তাই সুপেয় পানি নিশ্চিত করা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এখনই যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তারা বলবে, তাদের পূর্বপুরুষরা পানির মূল্য বোঝেনি, তাই আজ তারা ধ্বংসের মুখে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পানি অপচয় মানে জীবন অপচয়। এখনই সময় নদী-নালা খনন, বড় বড় জলাশয় তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পানির অপচয় রোধের। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা ভয়াবহ পানিসংকটে পড়ব, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সভ্যতাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।

লেখক : তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া