ভুয়া সাংবাদিকদের সাংঘাতিক আচরণ

মো: শামীম মিয়া

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ, একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের দেশ। আয়তন ছোট হলেও এখানে মিডিয়ার সংখ্যা বিস্ময়করভাবে অনেক। ছোট্ট দেশে এতো মিডিয়া কেন- superficially বিষয়টি সহজ মনে হলেও, বাস্তবে এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা। একদিকে এটি জনগণের তথ্য চাহিদার প্রতিফলন, অন্যদিকে প্রকাশ করে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যক্তিগত লোভ, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য এবং সবচেয়ে ভয়াবহ দিক- ভূয়া সাংবাদিকদের অপ্রতিরোধ্য উৎপাত।

সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। এটি সমাজের বিবেক, মানুষের কণ্ঠস্বর এবং সত্যের অটুট প্রতীক। প্রকৃত সাংবাদিকরা যাচাই-বাছাই, সততা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সংবাদ প্রকাশ করেন। তাদের লক্ষ্য হলো সমাজের অন্ধকারকে আলোকিত করা, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচার প্রকাশ করা এবং জনগণকে সচেতন করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছু ব্যক্তি এই মহৎ পেশাকে শুধু স্বার্থসিদ্ধি, ক্ষমতা বিস্তার এবং অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের কর্মকাণ্ড সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে।

ভূয়া সাংবাদিকদের আচরণ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং সমাজের জন্য বিপজ্জনক। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ আচরণ হলো চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। তারা সাধারণ মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপর ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করে। এই ধরনের আচরণ শুধুই সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটায় না, বরং জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলে। কখনও কখনও তারা তাদের পরিচয় ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও সুবিধা আদায় করে।

ভুয়া সাংবাদিকদের আরেকটি ভয়াবহ আচরণ হলো- মিথ্যা সংবাদ প্রচার। যাচাই-বাছাই ছাড়া তারা লাইভ বা ভিডিও প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থ বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাপ দেওয়ার জন্য তারা ঘটনার সত্য বিকৃত করে প্রচার করে। এই মিথ্যা খবর প্রায়শই সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে, মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বপন করে এবং সমাজকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়।

এছাড়া তারা প্রতারণামূলক পরিচয়পত্র এবং মিডিয়ার নাম ব্যবহার করে জনগণকে ধোঁকা দেয়। এই নকল পরিচয় তাদের প্রশাসনিক সুবিধা এবং সামাজিক মর্যাদা প্রদান করে। মানুষ প্রায়শই পত্রিকা বা মিডিয়ার নাম দেখে সাংবাদিককে বিশ্বাস করে। কিন্তু এই ভুয়া সাংবাদিকরা শুধু পরিচয় ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। এভাবে তারা প্রকৃত সাংবাদিকদের পরিশ্রম, সততা এবং নৈতিকতার স্বীকৃতি হরণ করে।

নৈতিকতার অভাব এই ভুয়া সাংবাদিকদের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত সাংবাদিকরা তথ্য-যাচাই করে সংবাদ প্রকাশ করেন; কিন্তু ভুয়া সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অর্থের বিনিময় দাবি করে বা বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্যও লজ্জাজনক। তারা সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে রূঢ়, দম্ভপূর্ণ আচরণ করে। ছোটখাটো মিডিয়ার নামকেই তারা অতিমাত্রায় মর্যাদার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে।

ছোট্ট দেশে এত মিডিয়ার উপস্থিতি শুধুমাত্র জনগণের তথ্যচাহিদা পূরণের জন্য নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ব্যবসা ও প্রভাব বিস্তার এবং আইনের দুর্বলতা। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা বা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার জন্য নামমাত্র মিডিয়া চালু করে। সাংবাদিক পরিচয় পেলে প্রশাসন বা সমাজে সুবিধা পাওয়া যায়। এই সুযোগকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা। মিডিয়া নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় থাকা ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যে কেউ সহজেই নামধারী মিডিয়া চালু করতে পারে।

ফলাফল হলো- জনগণের চোখে মিডিয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃত সাংবাদিকদের পরিশ্রম, সততা এবং নৈতিকতার স্বীকৃতি হারাচ্ছে। সমাজে বিভ্রান্তি, মিথ্যা তথ্য এবং ভুয়া খবরের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। মানুষ আর সংবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, বরং সন্দেহের চোখে দেখে। সংবাদপত্র বা অনলাইন মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

ছোট্ট দেশের সমাজে এতো মিডিয়ার উপস্থিতি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আরও জটিলতা তৈরি করছে। অনেক মিডিয়া চালু হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। বিভিন্ন দল ও নেতা তাদের স্বার্থ রক্ষা বা প্রতিপক্ষকে চাপ দেওয়ার জন্য মিডিয়া ব্যবহার করে। কেউ কেউ নিজেদের ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করতে মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ায় মিডিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু মান-গুণগত মান ও সত্য প্রকাশের নৈতিকতা কমে যায়।

এছাড়া ভুয়া সাংবাদিকদের কর্মকাণ্ড সমাজে অসাম্য তৈরি করছে। তারা বিভিন্ন ঘটনার সত্য বিকৃত করে প্রচার করে। কখনো এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থে।

ফলস্বরূপ, জনগণ বিভ্রান্ত হয়, সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং সমাজে বিশ্বাসের অবনতি ঘটে। বাস্তবে, একটি ঘটনা কতটা সত্য তা যাচাই করতে সাধারণ মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে। তারা শুধু মিডিয়ার নাম দেখে তথ্য বিশ্বাস করে।

আইনের ফাঁকফোকরও এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মিডিয়া নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় থাকা ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যে কেউ সহজেই মিডিয়া চালু করতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রায়শই এই নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নজরদারি রাখতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে ভুয়া সাংবাদিকরা সহজেই নিজেদের পরিচয় তৈরি করে নকল মিডিয়া চালু করে। এতে তারা প্রশাসনিক সুবিধা এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জন করে।

সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং ভুয়া সাংবাদিকদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বাস্তবে প্রশাসন প্রায়শই এই ধরনের ভূয়া মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। এটি একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, কারণ এর ফলে মানুষ অসতর্ক হয়, বিভ্রান্ত হয় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।

এ অবস্থায় জনগণেরও দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়ার নাম দেখে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা, তথ্য যাচাই করা, এবং সংবাদ উৎসের নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করা জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। প্রকৃত সাংবাদিকদের সমর্থন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যাতে তারা স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত সংবাদ প্রচার করতে পারে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকতা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে পেশাগত নৈতিকতা বজায় থাকে।

ছোট্ট দেশের সীমিত সম্পদে এত মিডিয়ার উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়- যে পেশা সত্য, ন্যায় এবং মানুষের জন্য, সেটি যদি অসৎ হাতে পরিণত হয়, তবে সমাজে বিভ্রান্তি, অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিতিশীলতার জন্ম হয়। তাই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- ছোট্ট দেশে কি সত্যিই এতো মিডিয়ার প্রয়োজন আছে, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অসৎ মানুষের স্বার্থ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং ভুয়া সাংবাদিকদের অমিতাচার?

সমাধানের পথ একমাত্র নৈতিক সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে সম্ভব। কঠোর আইন প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের সমর্থনই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব করবে। সমাজ, রাষ্ট্র ও মিডিয়ার তিনটি স্তর একসঙ্গে সচেতন হয়ে উঠলে শুধু ভুয়া সাংবাদিকদের উৎপাত নির্মুল করা সম্ভব হবে এবং মিডিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হবে।

লেখক : কলামিস্ট আমদিরপাড়া জুমারবাড়ী সাঘাটা গাইবান্ধা