পর্যটন ব্যবসার উদ্যোগ : সংস্কৃতি থেকে সম্ভাবনার সেতুবন্ধন
রাশেদুল ইসলাম সম্রাট
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের গল্প এখন আর শুধু অতীতের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি নয়- এটি হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার এক প্রাণবন্ত রূপরেখা। তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তি, নারীর অংশগ্রহণ এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি মিলিয়ে গড়ে উঠছে এমন এক সমাজ, যেখানে সৃজনশীলতা আর অন্তর্ভুক্তি একে অপরের পরিপূরক। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা উদ্যোগগুলো এখন জাতীয় পরিচয়ের নতুন ভাষা রচনা করছে। এই পরিবর্তন শুধু অর্থনীতির পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি এবং আত্মবিশ্বাসের গভীরে এক নতুন আলো ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক সম্পদ পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের জন্য এক অসীম সম্ভাবনার উৎস। সুন্দরবনের বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সিলেটের সবুজ চা-বাগান, কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, ষাট গম্বুজ মসজিদের স্থাপত্য সৌন্দর্য, পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক অলিগলি- এসব মিলিয়ে দেশকে একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। প্রতিটি অঞ্চলেই রয়েছে নিজস্ব গল্প, যা উদ্যোক্তাদের জন্য এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ শুধুমাত্র দর্শক টানার মাধ্যম নয়। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষার সঙ্গে মিলিত একটি সৃজনশীল উদ্যোগ। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং অর্থনীতি সুষমভাবে মিলে যায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ হোমস্টে, কৃষিপর্যটন, হস্তশিল্প কর্মশালা এবং সাংস্কৃতিক ভ্রমণ এমন উদ্যোগ, যা স্থানীয় মানুষের আয় বৃদ্ধি করে, দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং নগর অভিমুখী চাপ হ্রাস করে।
গ্রামীণ পর্যটন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গ্রামের জীবনযাপন, স্থানীয় সংগীত, নৃত্য, হস্তশিল্প, কৃষি অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং অপ্রচলিত প্রাকৃতিক দৃশ্য শুধু বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ নয়, বরং এটি স্থানীয় মানুষের জন্যও একটি টেকসই আয়ের উৎস হতে পারে। পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ এসব অভিজ্ঞতাকে বাজারজাত করে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্প, গ্রামীণ হোমস্টে বা কৃষ্টি-কর্মশালা উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বৈশ্বিক পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
ডিজিটাল বিপ্লব বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ব্লগ, ইউটিউব ভ্লগ এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এখন ছোট গ্রাম, অজানা জলপ্রপাত, ঐতিহ্যবাহী রাস্তা, স্থানীয় বাজার এবং প্রতিটি অনন্য স্থাপত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে। আগে যেখানে শুধু প্রচারণার জন্য বড় বাজেট এবং প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হতো, এখন উদ্যোক্তারা সামান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বৈশ্বিক পর্যটকদের নজরে আসতে পারছেন।
কিন্তু কেবল দৃশ্যমানতা অর্জন করলেই পর্যটন ব্যবসা সফল হয় না। দর্শককে ধরে রাখতে হলে মানসম্মত সেবা, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, নিরাপদ পরিবেশ এবং নিয়মিত ব্যবস্থাপনার নিশ্চয়তা থাকা অপরিহার্য। প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান যেমন মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন বুকিং সিস্টেম, ভার্চুয়াল ট্যুর, গাইডেড ভিডিও কনটেন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা গ্রাহকদের অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ, নিরাপদ এবং স্মরণীয় করতে পারেন।
এই ডিজিটাল সংযোগ শুধু দর্শকের জন্য সুবিধা তৈরি করে না, এটি স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বৈশ্বিক পর্যটকের সরাসরি সংযোগও স্থাপন করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিদেশি পর্যটক একটি গ্রামের হোমস্টে বুক করার সময় তার অ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় হস্তশিল্প, খাদ্য, গান ও নৃত্যের ভিডিও দেখতে পারে, গ্রামবাসীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে এবং আগমনের আগে অভিজ্ঞতার ধারণা পেতে পারে। এই প্রক্রিয়া স্থানীয় সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পর্যটকের সঙ্গে এক জটিল কিন্তু অর্থবহ সেতুবন্ধনে পরিণত করে।
ফলে, ডিজিটাল প্রযুক্তি শুধু ব্যবসার বিক্রয় বাড়ায় না, এটি বাংলাদেশি সংস্কৃতিকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগও তৈরি করে। অর্থাৎ, একটি ছোট গ্রাম বা অজানা প্রাকৃতিক স্থানও এখন বৈশ্বিক পর্যটনের জন্য হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের উদ্যোক্তারা শুধু ব্যবসায়ী নয়, তারা সংস্কৃতির দূত এবং সামাজিক উদ্ভাবকও। তাদের উদ্যোগ স্থানীয় শিকড়কে ধরে রাখে এবং তা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, এটি স্থানীয় গর্ব, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করে।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি স্থানীয় অর্থনীতি উদ্দীপিত করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, নারী, যুবক এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে। স্থানীয় দক্ষতা, হস্তশিল্প এবং জ্ঞান পর্যটন উদ্যোগে সংযুক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা সমভাবে বিতরণ করা সম্ভব। এটি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
আন্তর্জাতিকভাবে সফল পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের মডেলগুলো বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। কোস্টারিকা, ভুটান এবং ভিয়েতনাম প্রমাণ করেছে যে টেকসই, সম্প্রদায়ভিত্তিক পর্যটন জাতীয় উন্নয়নকে সমর্থন করতে পারে। বাংলাদেশও তার বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের কারণে এই মডেল প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত। তবে এর জন্য প্রয়োজন কৌশলগত পরিকল্পনা, নীতি সমর্থন এবং উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ।
নীতিমালা এবং অবকাঠামো সমর্থন ছাড়া পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব নয়। সড়ক, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট এবং পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। উদ্যোক্তাদের জন্য রিমোট লোকেশনগুলোতে লজিস্টিক বাধা দূর করা জরুরি। পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতা এবং টেকসই উদ্যোগ বাধ্যতামূলক।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ, সম্প্রদায় ক্ষমতায়ন এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জনের মাধ্যম। সঠিকভাবে পরিকল্পিত অভিজ্ঞতা এবং প্রফেশনাল মান নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, টেকসই এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে পর্যটন মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সমাজে নতুন উদ্দীপনা আনতে পারে। গ্রামীণ পর্যটন বিদেশি পর্যটকদের স্থানীয় জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত করার সুযোগ দেয়। শহুরে পর্যটন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য, সাংস্কৃতিক উৎসব এবং স্থানীয় শিল্পকে সামনে নিয়ে আসে। সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বনভূমি- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা সীমাহীন।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বৈশ্বিক দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ছোট গ্রাম, হোমস্টে এবং স্থানীয় উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা সম্ভব। এতে স্থানীয় ব্যবসা ও হস্তশিল্পও সমৃদ্ধ হয়।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ সামাজিক বন্ধন ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়িত করে, নতুন দক্ষতা তৈরি করে, স্থানীয় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখে। একই সঙ্গে এটি বৈশ্বিক পর্যটকদের শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল ভ্রমণ করার সুযোগ দেয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১৪০ কোটি পর্যটক ভ্রমণ করেন, যার ৭৩ শতাংশ এশিয়ায়। বাংলাদেশেও দেশি ও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
দেশের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ২০১০ সালে ১.৭ শতাংশ ছিল, যা এখন ৪.৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৭ সালে এটি ৭ শতাংশে পৌঁছানো। পর্যটন কেবল অর্থনীতিতে নয়, কর্মসংস্থানে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব বোঝা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে। ১৯৯৯ সালে সরকার এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে প্রায় ৮০০টি পর্যটন স্থান চিহ্নিত হয়েছে, তবে যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে শিল্পটি পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। সঠিক পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করে, পর্যটন শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ, সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং বৈশ্বিক সংযোগের শক্তিশালী হাতিয়ার। সৃজনশীল, দায়িত্বশীল এবং টেকসই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশ নতুন জীবিকার সুযোগ, সামাজিক ঐক্য এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশ শুধু একটি গন্তব্য নয়, এটি একটি জীবন্ত আর্কাইভ যেখানে নদী, পাহাড়, ঐতিহ্য এবং মানুষের সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে। এখন সময় এসেছে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সুযোগে রূপান্তর করার।
পর্যটন ব্যবসা উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে না, বরং বৈশ্বিক কল্পনায় নতুন পরিচয় গড়ে তুলবে। বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ, যেখানে সংস্কৃতি ও উদ্ভাবন মিলিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথ তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের সৃজনশীলতা একত্রিত হয়ে এখন একটি বৈশ্বিক পর্যটন সম্ভাবনার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।
লেখক : কলাম লেখক, গবেষক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
