ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা আল্লাহর দেওয়া পরীক্ষা

ডা. মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানবজীবন মূলত পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত। আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন ইবাদত, আনুগত্য এবং পরীক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে। মানুষের হাতে যে সম্পদ, ধন-সম্পত্তি, সন্তান, মর্যাদা ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয়- এসব কিছুই আসলে এক বিশাল পরীক্ষা। কখনও অভাব দিয়ে, আবার কখনও প্রাচুর্য দিয়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে যাচাই করেন। কোরআনে ঘোষণা করেছেন- আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা; আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। -(সূরা আল-বাকারাহ-১৫৫) এই আয়াত প্রমাণ করে, ধন-সম্পদ যেমন পরীক্ষা, তেমনি তার অভাবও পরীক্ষা। অর্থাৎ সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদা শুধু ভোগের বস্তু নয়; এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত এবং পরীক্ষা।

সম্পদ আল্লাহর পরীক্ষা : কোরআনের আলোকে আল্লাহতায়ালা বলেন- তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি শুধু পরীক্ষা, আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহা পুরস্কার। (সূরা আত-তাগাবুন -১৫) তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানরা যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ না করে। আর যারা এ কাজ করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আল-মুনাফিকুন-০৯)। হাদিসের আলোকে- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- কেয়ামতের দিন মানুষকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে... তার সম্পদ সম্পর্কে- সে কীভাবে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে।-(তিরমিজি, হাদিস-২৪১৭) অন্য হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে- আদম সন্তানের দুইটি জিনিস আছে যা কখনও পূর্ণ হয় না: তার ধন-সম্পদের লোভ এবং দীর্ঘ জীবনের আশা। (সহীহ বুখারি ৬৪৩৯, সহীহ মুসলিম ১০৪৮)

শিক্ষণীয় বিষয় : ধন-সম্পদ মানুষের জীবনে অপরিহার্য হলেও এর ব্যবহার নির্ধারণ করে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো কিনা। হালাল পথে উপার্জন, যাকাত আদায়, দান-সদকা এবং গরিবদের অধিকার আদায়ে ব্যয় করলে এটি জান্নাতের মূলধন হয়। বিপরীতে, হারাম উপার্জন, সুদ, ঘুষ, অন্যায় ভোগ-বিলাস ধ্বংস ডেকে আনে।

ক্ষমতা আল্লাহর পরীক্ষা : কোরআনের আলোকে- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন এবং যাকে ইচ্ছা ক্ষমতাচ্যুত করেন।- (সূরা আলে ইমরান-২৬) অন্যত্র বলেছেন- আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থাপন করেছি এবং জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।-(সূরা আল-আরাফ-১০)। হাদিসের আলোকে- রাসূল (সা.) বলেন- প্রত্যেকেই একজন রাখাল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করবে।-(সহীহ বুখারী-৭১৩৮, সহীহ মুসলিম : হাদিস-১৮২৯)

আরেক হাদিসে এসেছে- কোনো শাসক যদি প্রজাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (সহীহ বুখারী-৭১৫১, সহীহ মুসলিমণ্ড১৮২৯)।

শিক্ষণীয় বিষয় : ক্ষমতা শুধু সম্মানের নয় বরং ভয়াবহ জবাবদিহির দায়িত্ব। যারা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, দুর্বলদের অধিকার রক্ষা করে, তারা আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান হবে। আর যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তারা কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। সম্পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিণাম-

কারুনের কাহিনি : কারুন বিপুল ধন-সম্পদের অহংকারে ডুবে গিয়ে বলেছিল- এ সম্পদ তো আমার জ্ঞানের কারণে আমাকে দেওয়া হয়েছে। (সূরা আল-কাসাস ৭৮) ফলাফল- আল্লাহ তাকে তার ধন-সম্পদসহ ভূমিধসে ধ্বংস করেন।

ফেরাউন ও হামান : তারা ক্ষমতার অহংকারে নিজেদের প্রভু মনে করেছিল। আল্লাহ তাদের সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করেন। (সূরা আল-কাসাস ৪০)।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা : আজকের বিশ্বে দেখা যায়- যেসব রাষ্ট্র বা শাসক জনগণের অধিকার হরণ করে, দুর্নীতি ও অত্যাচারে লিপ্ত হয়, তারা ইতিহাসে নিন্দিত হয় এবং পতনের দিকে যায়। একইভাবে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ কিংবা ধনীরা যদি অহংকারে মত্ত হয়, সমাজ তাদের ঘৃণা করে।

সম্পদ ও ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার : হালাল উপায়ে উপার্জন, যাকাত, সদকা ও ওয়াকফ প্রদান, দরিদ্র, এতিম ও অসহায়দের সাহায্য করা, অপচয় ও বিলাসিতা থেকে বিরত থাকা।

ক্ষমতার ক্ষেত্রে করণীয় : ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার রক্ষা, সত্যকে সমর্থন এবং অন্যায়কে দমন, আল্লাহভীতি ও বিনয় অবলম্বন করা। রাসূল (সা.) বলেন- সাত শ্রেণির মানুষ কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে... তাদের একজন হলো ন্যায়পরায়ণ শাসক।-(সহীহ বুখারি- ৬৬০, সহীহ মুসলিমণ্ড ১০৩১)।

ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা : পরীক্ষার মূল রহস্য- আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তবে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও দান করব, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি কঠিন। (সূরা ইবরাহিম ০৭) এ থেকে শিক্ষা-সম্পদে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। ক্ষমতায় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অভাবেও ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, অতএব, সম্পদ ও ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত ও পরীক্ষা। কেউ যদি এগুলো হালাল উপায়ে ব্যবহার করে এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে, তবে তা জান্নাতের পথ প্রশস্ত করবে। আর যদি অহংকার, স্বার্থপরতা ও অন্যায়ের পথে ব্যবহার করে, তবে তা ধ্বংস ডেকে আনবে। ধন-সম্পদ হোক বা ক্ষমতাণ্ড এগুলো চিরস্থায়ী নয়। প্রকৃত স্থায়ী পুরস্কার শুধু আল্লাহর কাছে। তাই আমাদের উচিত প্রতিটি অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা, কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্য অবলম্বন করা এবং মানুষের হক আদায় করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সম্পদ ও ক্ষমতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফিক দান করুন, আমীন।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি