বঞ্চিত শৈশব বিপন্ন ভবিষ্যৎ

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শহরের গহ্বর যেন এক অনির্দিষ্ট গহীন অতল, যেখানে প্রতিদিন জন্ম নেয় অগণিত কোলাহল, আবার সেই কোলাহলের অন্তরালে নিঃশব্দে লীন হয়ে যায় বঞ্চিত শিশুদের নীরব আর্তি। রাজধানীর ব্যস্ততম রেলস্টেশন কেবলমাত্র যাত্রী পরিবহনের কেন্দ্র নয়, বরং এটি এক অব্যক্ত সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের মঞ্চ, যেখানে সভ্যতার অর্জন এবং অমানবিক অবক্ষয় একত্রে প্রতিফলিত হয়। প্ল্যাটফর্মের প্রতিটি পলিশ করা মেঝেতে যাত্রীদের পদচারণা যেন আধুনিকতার প্রতীক, কিন্তু একই মেঝেতে লুকিয়ে আছে এক অন্য পৃথিবী- যেখানে শিশুদের হারানো শৈশব, তাদের নেশা, অনাথত্ব এবং সমাজের উদাসীনতা মিলেমিশে গড়ে তোলে এক ভয়াবহ বাস্তবতা।

এই শিশুদের হাতে নেই বই, নেই খাতা, নেই কোনো শৈশবের আনন্দ। তাদের হাতে আছে একটি ছেঁড়া ব্যাগ, যার ভেতরে ভরা থাকে বিষাক্ত বাষ্পে পূর্ণ আঠার কৌটা। তারা সেই ব্যাগ মুখে চেপে শ্বাস নেয়, আর মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় ক্ষুধা, ভুলে যায় ভয়, ভুলে যায় তাদের হারানো পরিবার এবং সমাজের অবহেলা। এই ক্ষুদ্র নেশার মুহূর্তগুলোই তাদের জন্য একমাত্র স্বস্তি, কিন্তু সেই স্বস্তি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সূত্রপাত। তাদের ফুসফুস, মস্তিষ্ক, স্নায়ু এবং হৃদয় ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নেশার ঘোরের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয় তাদের মানবিক সম্ভাবনা, এবং ক্ষুধা-যন্ত্রণা দ্বারা প্ররোচিত অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন জাগে- এই শিশু কেন এই পথে প্রবাহিত হয়? সমাজের অন্ধ দৃষ্টি বলবে তারা অপরাধী, তারা অনৈতিক, তারা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু বাস্তব সত্য ভিন্ন। তারা হল সমাজের ব্যর্থতার জীবন্ত প্রমাণ, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার সরাসরি প্রতিফলন, আমাদের নৈতিকতার নিকৃষ্ট চিত্র। আমরা যখন গর্ব করি শিক্ষার বিস্তৃতি, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে, সেই সময়ে এক প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের শৈশব নষ্ট হচ্ছে। সমাজ কেবল চুপচাপ দেখছে, আর আমরা নিজেদেরকে নির্বিকার দর্শক বানিয়ে দিচ্ছি। শৈশব আসলে কেবল বয়সের একটি ধাপ নয়; এটি চিন্তা, নৈতিকতা, আবেগের শিকড়ের নির্মাণের সময়। এই শিশুরা সেই মৌলিক ভিত্তি থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র?্য, অনাথত্ব, পারিবারিক সহিংসতা, সামাজিক অবহেলা- সব মিলিয়ে তাদেরকে মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। পরিবার আশ্রয় না দিলে, রাষ্ট্র দায় পালন না করলে, সমাজ সহানুভূতি না দেখালে, শিশুরা রাস্তার দিকে ধাবিত হয়। রাস্তা মানেই ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা এবং মাদকের ফাঁদ। আঠা, যা মূলত শিল্পের জন্য আবশ্যক, শিশুদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর হাতিয়ার। এরমধ্যে থাকা টলুইন, বেনজিন, এসিটোন দ্রুত বাষ্পে পরিণত হয়ে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে, এনে দেয় ক্ষণিকের ঘোর। এই ঘোরই তাদের একমাত্র স্বস্তি। চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার ধ্বংস করে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, ফুসফুসের ক্ষমতা, এবং স্নায়বিক স্থিতি। শিশুদের জন্য এই মুহূর্তের আনন্দ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হিসেবে ফিরে আসে। রাষ্ট্র কোথায়? সমাজ কোথায়? শিশু অধিকার সুরক্ষার আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি, সবই কাগজে-কলমে বিদ্যমান। বাস্তবে, কার্যকর ব্যবস্থা খুবই সীমিত। বেসরকারি সংস্থা কিছু চেষ্টা করে, আশ্রয় দেয়, খাদ্য দেয়, শিক্ষা দেয়, কিন্তু ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা এই বিস্তৃত সমস্যার তুলনায় নগণ্য। রাষ্ট্রের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংকট কখনও সমাধান হবে না। রাষ্ট্র ব্যস্ত থাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, উন্নয়ন প্রদর্শনী, রাজনৈতিক কোলাহলে। শিশুর আর্তনাদ নীরব থাকে। সমাজও কম দায়ী নয়। আমরা যারা শিক্ষিত, সুস্থ-সচ্ছল, সভ্য বলে মনে করি, শিশুকে রাস্তায় দেখলে বিরক্ত হই। গাড়ির জানালায় টোকা দিলে মাথা ঘুরাই, ট্রেনের কামরায় জায়গা চাইলে ধমক দেই, নেশাগ্রস্ত শিশু দেখে অবজ্ঞা করি। অথচ শিশুটি আসলে আমাদেরই প্রতিফলন। আমাদের ব্যর্থতার আয়না। যদি মানবিক হতেন, কোনো শিশু কখনও প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকত না, আঠার নেশায় ডুবে যেত না। অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, এই শিশুদের অনেকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সংগঠিত অপরাধে। প্রথমে ভিখারি, পরে চোর, অবশেষে বড় অপরাধচক্রের অংশ। বড়রা ব্যবহার করে অস্ত্র বহনে, মাদক পরিবহনে, খুনোখুনির কাজে। যে শিশুটি জন্মেছিল হাসতে খেলার জন্য, সে পরিণত হয় সমাজের আতঙ্কে। এভাবে নষ্ট হয় একটি প্রজন্ম, যা আসলে গোটা জাতির ক্ষয়। একটি রাষ্ট্র কেবল অবকাঠামো দিয়ে টিকে থাকে না; টিকে থাকে মানুষের ওপর, বিশেষত শিশুদের ওপর, যারা ভবিষ্যতের ধারক। শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদের ‘অপরাধী’ বলা যায় না। তারা অপরাধীর শিকার। তাদের প্রয়োজন চিকিৎসা, শিক্ষা, স্নেহ ও পুনর্বাসন। যারা দীর্ঘদিন অবহেলায় বড় হয়, তারা ইতিবাচক চিন্তার ক্ষমতা হারায়। ক্ষোভ, হিংসা, উদাসীনতা জন্ম নেয়। পুনর্বাসন ছাড়া তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, পুনর্বাসন প্রোগ্রাম, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, এবং সমাজের সহানুভূতি। সমাজ যদি মনে করে, শিশুরা অন্যের বোঝা, পরিবর্তন আসবে না। প্রতিটি শিশু আমাদেরই সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি তাদের হারাই, ভবিষ্যৎও হারাবে।

কমলাপুর স্টেশনের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম, প্রতিটি সাইরেন আসলে এক ভয়াবহ সতর্কসংকেত। এটি বলে দিচ্ছে- আমরা আমাদের শৈশব হারাচ্ছি। শৈশব হারালে সভ্যতার ভিত্তি ধসে পড়ে। এখনই সময় রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে একসঙ্গে এগিয়ে আসার। শিশুদের ফিরিয়ে আনতে হবে আলোয়, খেলায়, হাসিতে। না হলে আমরা দেখব এক অন্ধকার প্রজন্মের উত্থান, যা হবে সমাজের অমোঘ অভিশাপ।

শিশুদের হারানো শৈশব কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক বিপর্যয়ের সূচক।

লেখক : কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা