বাংলাদেশ ও রাখাইনের দ্বন্দ্বপূর্ণ বাস্তবতা

এস.এম হাসানুজ্জামান

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ আজ একটি অনিশ্চিত ও সংবেদনশীল মানবিক সংকটের মুখোমুখি, যা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ও স্থানীয় বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরে। বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে।

এই সংখ্যাগুরু জনসংখ্যা স্থানীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত কাঠামোর ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নেয়, যা রোহিঙ্গা জনসংখ্যাকে দ্রুত বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, রাখাইনের বাসিন্দা রোহিঙ্গার সংখ্যা কমে মাত্র পাঁচ লাখের নিচে নেমেছে। সেখানে চলমান নিপীড়ন, হত্যা, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে মানুষকে নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হচ্ছে। এভাবে একদিকে রাখাইন রোহিঙ্গাশূন্য হচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগণের অধিকার, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ভারসাম্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনের মূল কারণ চিহ্নিত ও প্রতিরোধ না করলে দীর্ঘমেয়াদে এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং মানবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। স্থানীয় জনগণ দীর্ঘসময় ধরে রোহিঙ্গা সংকটের সরাসরি প্রভাব ভোগ করছে।

কক্সবাজারের পরিবেশে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বন উজাড়ের মাধ্যমে ক্যাম্প তৈরি হওয়ায় স্থানীয় জীববৈচিত্র?্য ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে। বানর, সাপ, শকুন, বন্য শিকারী এবং স্থানীয় প্রাণীবিশ্বের ওপর প্রভাব মারাত্মক। বনাঞ্চল হারানো মানে শুধু স্থানীয় জীববৈচিত্র?্য ক্ষতিগ্রস্ত নয়, বরং মাটি ক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূ-পরিবেশগত ভারসাম্যও বিঘ্নিত হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের ফলে স্থানীয় জনগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে আছে। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাকরি এবং শ্রমবাজারে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। চাঁদাবাজি, মাদক, খুন, অপহরণ এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধে রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্রমাগত ব্যস্ত। এই পরিস্থিতি কক্সবাজারকে শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন শিল্পের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে সীমান্ত পেরিয়ে রাখাইন থেকে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় বৃহত্তম অংশ নারী ও শিশু। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ১ লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছে, বাকিরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পে বসবাস করছে।

অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমি এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। এভাবে রোহিঙ্গা সংকট বহুমাত্রিক ও জটিল রূপ নিচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থান স্থানীয় জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে। স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, খাদ্য নিরাপত্তা, শ্রমবাজার এবং পরিবেশ হুমকির মুখে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, মাদক, খুন, অপহরণ এবং ধ্বরের মতো অপরাধে রোহিঙ্গাদের জড়িততা পুলিশের নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজনীয় করছে।

একটি অতিপ্রাসঙ্গিক বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দায়িত্বশীল পদক্ষেপের বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- এনজিও/এজিও এবং ক্যাম্প কর্মকর্তাদের স্বার্থপর ভূমিকা। দীর্ঘদিন ধরে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আত্মরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন হলে তাদের কর্মসংস্থান ও প্রকল্প তহবিল কমে যাবে, ফলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই তারা প্রায়শই সংকট সমাধানে গতি দেয় না।