স্বীকৃতি যত বাড়ে, গাজার কবর তত গভীর হয়

এসএম রায়হান মিয়া

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিন প্রশ্ন আজ শুধু একটি ভূখণ্ডের দাবির বিষয় নয়, এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবতার অন্যতম কঠিন পরীক্ষাক্ষেত্র। বহু দশক ধরে এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও বাস্তবতা হলো- গাজার মাটিতে প্রতিদিন রক্ত ঝরছে, শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছে, আর পুরো একটি জাতি জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মরুভূমির ধূলিকণার মতো ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর চারদিকে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রসত্তার স্বীকৃতি দিয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ১৪৭টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির সংখ্যাগত বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে এক নৈতিক বিজয়, কিন্তু বাস্তবতার প্রশ্নে এটি আজও এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্য তৈরি করে- কারণ স্বীকৃতি যত বাড়ছে, গাজার কবরও তত গভীর হচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি শুধু নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল, ভূরাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সমন্বিত ফল। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার বহু রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের নিজেদের উপনিবেশবিরোধী ইতিহাসের কারণে। তারা ফিলিস্তিনের সংগ্রামে নিজেদের অতীতের প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো, বিশেষত কিউবা, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও বলিভিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো, ফিলিস্তিনের প্রশ্নে সবসময় সরব থেকেছে কারণ তারা নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পশ্চিমা শক্তির দমননীতি ও দ্বৈত মানদ-ের শিকার। অপরদিকে মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনকে শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা থেকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে ফিলিস্তিনের মুক্তি শুধু একটি রাজনৈতিক স্বপ্ন নয়, বরং এটি ধর্মীয় আবেগ, ন্যায়বোধ এবং সামষ্টিক অস্তিত্বের প্রতীক। ফলে এই দেশগুলোর সরকারগুলো নিজেদের জনগণের চাপ এড়াতে পারলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।

কিন্তু সমস্যা হলো- স্বীকৃতির সংখ্যা যতই বাড়ুক, বাস্তব ময়দানে ফিলিস্তিনের অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যায়। এর কারণ নিহিত আন্তর্জাতিক কূটনীতির বাস্তববাদী চরিত্রে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়, ন্যায়বোধ বা মানবিকতা সেখানে গৌণ। যে কারণে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় শক্তিগুলো, ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন বজায় রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য পাঠায় ইসরায়েলের জন্য, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম থেকে শুরু করে উন্নততম অস্ত্র প্রযুক্তি পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও প্রযুক্তি জড়িত। ইউরোপীয় শক্তিগুলোও প্রায় একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও মাঝে মাঝে তারা মানবিকতার বুলি আওড়ায়, যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। কিন্তু যখন আসল সিদ্ধান্তের মুহূর্ত আসে- অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া, কিংবা ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাঁড় করানো- তখনই তারা পিছিয়ে যায়। ফলে বোঝা যায় যে স্বীকৃতি মূলত প্রতীকী ও নৈতিক শক্তি বহন করলেও বাস্তব পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত।

এই দ্বৈতনীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেখা যায়। সাধারণ পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ প্রশ্নে বারবার যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যদের হাতে যে ভেটো ক্ষমতা রয়েছে, তা আসলে সমগ্র বিশ্বকেই কয়েকটি রাষ্ট্রের বন্দি করে রেখেছে। ফলে ফিলিস্তিন প্রশ্নে যখনই কোনো শক্তিশালী প্রস্তাব আসে, যুক্তরাষ্ট্র সেটিকে ভেটো দিয়ে নস্যাৎ করে দেয়, আর ইসরায়েল অবাধে তাদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যায়। এ অবস্থায় স্বীকৃতি সংখ্যায় যতই বাড়ুক, গাজার শিশুর চোখে সেটি অশ্রুর চেয়েও বেশি কিছু নয়।

যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতায়ও বিষয়টি স্পষ্ট। গাজা উপত্যকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অতি সীমিত পরিসরে জীবনযাপন করে। দীর্ঘ অবরোধ, খাদ্য ও ওষুধ সংকট, বোমাবর্ষণ, অবকাঠামো ধ্বংস- সব মিলিয়ে গাজা যেন একটি জীবন্ত কারাগার। হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়েছে, স্কুলগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের ওপরও বোমা পড়ছে। শিশুদের খেলনা হয়ে উঠেছে ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো, তাদের পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। এই বাস্তবতায় যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুন নতুন স্বীকৃতির তালিকা প্রকাশ করে, তখন সেটি ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে অনেকটা ব্যঙ্গাত্মকই মনে হয়- কারণ তাদের বাস্তব জীবনে কোনো পরিবর্তন আসে না।

তবে এটাও সত্য যে এই স্বীকৃতিগুলো পুরোপুরি অর্থহীন নয়। প্রতিটি স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ফিলিস্তিনের অবস্থানকে একটু একটু করে শক্তিশালী করছে। ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করার বৈধতা পায়, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় ভোটাধিকার পায় এবং কূটনৈতিকভাবে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি ইসরায়েলের জন্য এক নৈতিক পরাজয় এবং কূটনৈতিক চাপের উৎস। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা আজ যা চায় তা ভবিষ্যতের কূটনৈতিক লাভ নয়, তারা চায় আজকের রক্তপাত থামুক, আজকের শিশুরা বাঁচুক, আজকের ঘরবাড়ি রক্ষা পাক। আর এই বাস্তবতা প্রতিদিন প্রমাণ করছে যে, স্বীকৃতি আর মানবিক সংকটের মধ্যে একটি বিশাল ফাঁক রয়ে গেছে।

এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে এক সময় সারা বিশ্ব ক্রীড়া, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও কূটনৈতিক অঙ্গনে সর্বাত্মক বর্জন গড়ে তুলেছিল। কোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে অংশ নিতে দেওয়া হতো না, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছিল, এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই সর্বাত্মক চাপই শেষ পর্যন্ত বর্ণবাদী শাসন ভেঙে দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিন প্রশ্নে সেইরকম ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর বয়কট দেখা যায়নি। বরং ইসরায়েলের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তিগুলোর ব্যবসায়িক ও সামরিক সম্পর্ক ক্রমে আরও গভীর হয়েছে। ফলত ফিলিস্তিনের সংগ্রাম কেবল প্রতীকী স্বীকৃতির ভেতর আটকে গেছে। তবে ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলন করছে, একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন ইসরায়েলবিরোধী বয়কটের আহ্বান জানিয়েছে, অসংখ্য শহরে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন নতুন প্রজন্মের তরুণেরা ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে দাঁড়াচ্ছে। এই আন্দোলনগুলো দেখাচ্ছে, যে জনগণ ন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন, যদিও সরকারগুলো কৌশলগত কারণে নীরব থাকে। এক সময় এই জনমত রাজনৈতিক চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু ততদিনে হয়তো ফিলিস্তিনের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। ফিলিস্তিন প্রশ্ন আমাদের আরেকটি শিক্ষা দেয়- আন্তর্জাতিক কূটনীতির নৈতিকতা আসলে একটি প্রতীকী পর্দা মাত্র, এর আড়ালে শক্তির নগ্ন বাস্তবতাই কাজ করে।

যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ভেটো ব্যবহার করে, ইউরোপ যেভাবে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং আরব বিশ্বের বড় অংশ যেভাবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে নীরব থাকে- সবই প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জগতে ন্যায়ের শক্তি সবসময় শক্তিধর রাষ্ট্রের স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু তবুও জনগণের আন্দোলন, নৈতিক অবস্থান ও প্রতীকী স্বীকৃতিগুলো এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের অংশ, যা হয়তো একদিন বাস্তব পরিবর্তন আনবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গাইবান্ধা