প্রান্তিক কৃষকের ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত
রাশেদুল ইসলাম সম্রাট
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি এখনও কৃষি। দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা এবং জীবিকার প্রধান অবলম্বন এই খাতেই নিহিত। কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লেও, কৃষকের হাতে পৌঁছায় না তার ন্যায্য মুনাফা। বছরের পর বছর ধরে কৃষি বিপণনের নিয়ন্ত্রণ ছিল মধ্যস্বত্বভোগী ও প্রচলিত বাজারব্যবস্থার হাতে, যেখানে স্বচ্ছতা ও দক্ষতার অভাব প্রকট। ফলে একদিকে ভোক্তাকে পণ্য কিনতে হয়েছে অতিরিক্ত দামে, অন্যদিকে উৎপাদক কৃষক বঞ্চিত হয়েছেন তার প্রাপ্য মূল্য থেকে।
এই অদক্ষ, অসংগঠিত এবং কৃষকবিরোধী বিপণন কাঠামোই কৃষিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে একটি উৎপাদনমুখী অথচ অনগ্রসর খাতে। কৃষকের শ্রমের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ায়, তারা উৎসাহ হারাচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং কৃষককেন্দ্রিক বিপণন ব্যবস্থা, যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীর নয়, কৃষকের কণ্ঠস্বরই হবে মুখ্য।
এ প্রেক্ষাপটে কৃষি বিপণনের ডিজিটাল রূপান্তর বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মোবাইল অ্যাপ, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল ওয়ালেট ও মোবাইলভিত্তিক তথ্যসেবা কৃষিকে এনে দিচ্ছে স্বচ্ছতা, সরাসরি কৃষক-ভোক্তা সংযোগ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ। যদিও গ্রামীণ এলাকায় দুর্বল ইন্টারনেট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও ডিজিটাল স্বাক্ষরতার ঘাটতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবু ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সূচনা ঘটছে।
আজকের বাংলাদেশে চালডাল, খাস ফুড কিংবা আগ্রোশিফটের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কৃষকের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি শহুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। তরুণ কৃষকরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাজারদর বা চাষাবাদ সংক্রান্ত পরামর্শ পাচ্ছেন। বিকাশ ও নগদের মতো ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতি কৃষকের অর্থপ্রাপ্তিকে সহজ করছে, সময়ক্ষেপণ হ্রাস করছে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আনছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায়। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশন, এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ের উদ্যোগ এবং বেসরকারি এগ্রিটেক কোম্পানির নতুন মডেল একে আরও ত্বরান্বিত করছে।
ডিজিটাল কৃষি বিপণনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো বাজারে সরাসরি প্রবেশাধিকার এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। যেখানে একসময় কৃষক বাধ্য হতেন স্থানীয় ফড়িয়ার কাছে কম দামে উৎপাদন বিক্রি করতে, সেখানে এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা সরাসরি পৌঁছাতে পারছেন ভোক্তা, পাইকারি ক্রেতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বাজারে। এর ফলে দাম নির্ধারণে কৃষকের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ছে, প্রতারণা ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমছে এবং বাজারব্যবস্থায় একটি ন্যায্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
এই রূপান্তরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রসার। মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এখন সহজেই ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন এবং তাৎক্ষণিক অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ পাচ্ছেন, যা তাদের উৎপাদন সক্ষমতা ও বাজারে টিকে থাকার শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ডিজিটাল পদ্ধতির আরেকটি বড় সুবিধা হলো দক্ষতা বৃদ্ধি। রিয়েলটাইম ট্র্যাকিং, সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থা কৃষিপণ্যের অপচয় কমাচ্ছে। এর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমছে এবং ভোক্তাও পাচ্ছে কমদামে নিরাপদ পণ্য। শিক্ষিত তরুণরা প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক কৃষিতে আগ্রহী হচ্ছে, যা গ্রামীণ বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও কৃষিপণ্য প্রবেশ করছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
তবে, এতসব ইতিবাচক দিকের মাঝেও রয়েছে জটিল বাস্তবতা। অনেক কৃষকের এখনও স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা নেই; যাকে বলে ‘ডিজিটাল বিভাজন।’ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যেমন দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহ ও গ্রামীণ লজিস্টিকস সমস্যা এ রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করছে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো আস্থার ঘাটতি- কৃষকরা অনেক সময় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতারণা, দেরি করে পেমেন্ট বা পণ্য সরবরাহ অনিশ্চয়তার কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এর এঙ্গে যুক্ত হয় আর্থিক চাপ; কারণ স্মার্টফোন, ইন্টারনেট প্যাকেজ বা প্ল্যাটফর্ম ফি অনেক কৃষকের নাগালের বাইরে।
শুধু তাই নয়, কৃষি ই-কমার্সে এখনও সুসংগঠিত আইনগত কাঠামো তৈরি হয়নি। ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা, ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণ ও ডেটা নিরাপত্তা বজায় রাখার মতো নিয়মাবলি দুর্বল। তাছাড়া সাইবার প্রতারণা, তথ্য চুরি বা হ্যাকিংয়ের মতো ঝুঁকিও রয়েছে। ফলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের মধ্যে শঙ্কা থেকেই যায়।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা গেলে বাংলাদেশের কৃষি বিপণন এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ফসলের উৎপাদন ও বাজার চাহিদার পূর্বাভাস দিতে পারে; ব্লকচেইন প্রযুক্তি বাণিজ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে; আর ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) সাপ্লাই চেইনকে আরও কার্যকর করতে পারে। সরকার যদি ভর্তুকির মাধ্যমে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন সরবরাহ করতে পারে, গ্রামীণ আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করে এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করে, তবে কৃষকরা আরও দ্রুত এ রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
পাশাপাশি দরকার শক্তিশালী আইন ও নীতি কাঠামো, যাতে কৃষি ই-কমার্সে ভোক্তা সুরক্ষা, ন্যায্য প্রতিযোগিতা ও তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। একাডেমি, সরকার ও শিল্প খাতের সমন্বিত উদ্যোগ হলে এ খাতে আরও উদ্ভাবন আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগযোগ্য সমাধান তৈরি করতে পারবে, সরকার সেগুলোকে সম্প্রসারণ করবে এবং বেসরকারি খাত বিনিয়োগ ও দক্ষতা এনে কার্যকর করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানসিকতার পরিবর্তন। কৃষককে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আস্থাশীল করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন তাদের কাছে সহজ প্রশিক্ষণ, তথ্যসেবা ও প্রতারণামুক্ত অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়া। একইসঙ্গে ভোক্তার আস্থা অর্জন করতে হবে পণ্যের মান, সময়মতো সরবরাহ ও সঠিক দামের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের কৃষি খাত আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারিত হবে একটি সুসংগঠিত ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে। এটি শুধু প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়, বরং একটি গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন, যার মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য পাবেন, ভোক্তা নিশ্চিত হবেন নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যে এবং দেশ অর্জন করবে খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দৃঢ় ভিত্তি।
এই রূপান্তর যদি সময়মতো বাস্তবায়িত না হয়, তবে কৃষি খাতের সীমাবদ্ধতা আরও গভীর হবে, এবং কৃষকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে। তাই কৃষিকে সত্যিকার অর্থে টেকসই করতে হলে এখনই ডিজিটাল কৃষি-বিপণনকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে নিয়ে আসা জরুরি। এটি আর বিলাসিতা নয়, এটি সময়ের দাবি, ভবিষ্যতের প্রয়োজন এবং ন্যায়ের প্রশ্ন।
লেখক : কলাম লেখক, শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
