পরিবেশ সংরক্ষণে বনভূমি ও বন্যপ্রাণী

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের রাজধানী থেকে ঘুরে গিয়ে এক বিদেশি নাকি মন্তব্য করেছেন, ঢাকা শহর ইটের তৈরি এক বস্তি শহর। মনে পড়ে গেল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চরণ, ইটের পর ইট, মাঝখানে মানুষ কীট।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকাল এটাই আমাদের শহরের জীবনে এক নিদারুন বাস্তবতা।

দেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী প্রভৃতি শহরে ইটের পর ইট যেভাবে গাঁথা হচ্ছে, যত্রতত্র আকাশচুম্বী ভবন নির্মিত হচ্ছে, মাঝখানে মানুষের অবস্থা দাঁড়িয়েছে কীটের মতই। উইপোকা যখন ঢিবি তৈরি করে, তখন তাদের একটা পরিকল্পনা থাকে, যাতে বসবাসের স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তার সমস্যা না হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাদের পরিকল্পনা প্রায় অপরিবর্তিত আকারে সঞ্চারিত হয়ে আসছে।

আমরা সামাজিক জীব। সামাজিক জীব যখন বসতি নির্মাণ করে, তখন তাদেরও মনে থাকে সচেতন কিছু ইচ্ছা। ইচ্ছাগুলো হচ্ছে সম্পদ আর স্বাচ্ছন্দ্যের। কিন্তু এক সময় দেখা যায় ওই সম্পদ আর স্বাচ্ছন্দ্য জমা হতে হতে বিশাল এক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই বোঝার নিচে চাপা পড়তে থাকে মানুষ। মানুষের জীবনে এটা এক ধরনের নির্বাসন। এই নির্বাসনের সমস্যাটা যদি মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হতো তবে তা বৃহত্তর সমাজের পক্ষে অনেকটা কল্যাণকর হতো।

আসলে রাশি রাশি সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্য জড়ো করতে গিয়ে বর্তমান যুগের মানুষ তার পশ্চাৎপট খুইয়েছে। সেই পশ্চাৎপট হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতিকে মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবা যায় না, প্রতিপক্ষও ভাবা যায় না। কেননা, মানুষ প্রকৃতির সন্তান। শব্দটার মূলগত অর্থ নিরবচ্ছিন্নতা বা ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ প্রকতির সঙ্গে মানুষ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। কিন্তু ইদানিং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টবিরোধী সম্পর্ক পৃথিবীর পরিবেশকে বিশেষ করে শিল্প সভ্যতা, বনভূমি ও বন্যপ্রাণীকে এক বিপজ্জনক পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, দূষিত করছে বাতাস ও পানিকে।

বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী লাগামছাড়া শিল্পায়নের কারণে বায়ুমন্ডলে ব্যাপকভাবে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ম মোতাবেক কলকারখানা গড়ে না উঠায় এ বিপত্তি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পুরাতন রুগ্ন শিল্প কারখানাগুলো আর্থিক অভাব অনটনের কারণে যেমন দূষণরোধী প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারছে না, তেমনি নতুন কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে আইন কানুন সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের বিজ্ঞানসম্মত কৃষিব্যবস্থা না থাকায় বর্ধিত জনংসখ্যার চাপ সামলাতে কোপ পড়েছে অরণ্য ও বন্যপ্রাণীর ওপর। অপরদিকে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কর্মসূচিতে রয়েছে ত্রুটি-বিচ্যুতির অভিযোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংরক্ষণের আওতায় থাকছে শুধু বৃহৎ আকার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের। কিন্তু অমেরুদণ্ডী ছোট ছোট প্রাণীদের রক্ষায় তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

অতি ক্ষদ্র প্রাণীরা তো কর্তব্যের বাইরে। এইভাবে অরণ্যের বৃহৎ প্রজাতির বৃক্ষ তাদের ছোট ছোট উদ্ভিদ ও লতাগুলো ক্রমশ পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বারোপ করা হয়েছে জৈব-বৈচিত্র্যের ওপর। জৈব-বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ বলতে বোঝায় মানুষসহ যাবতীয় প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং সর্বপ্রকার জেনেটিক উপাদানের যথাযথ সংরক্ষণ। আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্পর্কটা মোটেও মানুষ বনাম প্রকৃতি নয়। জৈবতত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে জীবের সৃষ্টি বা অবলুপ্তিনির্ভর করে ‘যোগ্যতমের উদবর্তনে’র ধারায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ কোনো জীবের বিলুপ্তির কারণ। সুতরাং শুধু পরিবেশের লাবণ্যের জন্য নয়, আত্মরক্ষার তাগিদেও মানুষকে হতে হয় প্রকৃতিপ্রেমী তথা প্রাণীপ্রেমী। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, প্রাণের সঙ্গে অপ্রাণের এই যে ধারাবাহিকতাণ্ডআধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানে তা স্বীকৃত। আকাশ আর মাটি, সমুদ্র আর বাতাস, উদ্ভিদ আর প্রাণী জগৎ, সবকিছু মিলেমিশে পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি আপন কক্ষপথে আবর্তিত।

প্রাণ আর আপ্রাণ মিলেই এ পৃথিবী। এর প্রতিটি খণ্ড অংশ অন্য সমস্ত অংশের সঙ্গে খুবই সক্রিয়ভাবে যুক্ত। কোনো কারণে একাংশে যদি কোনো বদল আসে কিংবা আলোড়ণের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব অচিরেই অন্য অংশে গিয়ে পড়বে। এক অংশে কোনো আঘাত আসে তবে সমস্ত গ্রহটাই সাড়া দেবে তাতে। যেমন কম্পিউটারের কোনো একটি সুক্ষাংশ বিগড়ে গেলে গোটা যন্ত্রই বিকল হয়ে যায়, তেমনি মানুষ, মাটি, পানি নির্ভরশীল, পরস্পর ভাসাম্যময় এক পরিবেশে বিরাজমান। কোথাও সামান্য আঘাত লাগলে ছিন্ন হয়ে যায় ইকোলজির বন্ধন। জলবায়ু তাপমাত্রা আদ্রতা ও অমøতার পরিমাণের সামান্যতম হেরফের পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন এমনকি লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাই এটা স্পষ্ট যে, মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গের সঙ্গে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে আমাদের চলতে হবে।

বলাবাহুল্য পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই পরিবেশকে অবশ্যই দূষণমুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে সমস্যা হবে মানুষেরই। যদিও বায়ু প্রবাহে মাটি থেকে প্রচুর ধূলিকণা উঠে আসে নানা প্রকার রোগজীবাণু, ভাইরাস ইত্যাদি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সঙ্গে আসে প্রচুর উল্কাভস্ম এবং সমুদ্র থেকে ভেসে আসা অজস্র লবণ-কণা। প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে এ রকম বায়ুদূষণ সবার অলক্ষ্যে স্বতত ঘটে চলছে।

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে আজকাল বায়ুদূষণের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কল-কারখানা, যানবাহন ইত্যাদিতে পেট্রল কয়লা, মবিল পোড়ানো থেকে নির্গত ধোঁয়া সালফার-ডাই অক্সাইড গ্যাস, হাইড্রোকার্বন বাষ্প, সীসা নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি মুক্ত বাতাসকে প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে। ধোঁয়া আর কুয়াশার মিশ্রণে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হচ্ছে তার দাপট কম নয়। এটা শ্বাস-প্রশ্বাসের বিঘ্ন ঘটায়। ধোয়াশার মধ্যে কিছু ওজন-গ্যাসও থাকে, যা উদ্ভিদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক। এভাবে বায়দূষণ আধুনিক মানুষের দোরগোড়ায় নেকড়ে বাঘ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণের এ দূরবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একান্তই কাম্য, তা যে কোনো মূল্যেই হোক।

বায়ুদূষণ প্রতিরোধে বনানী বা গাছপালার ভূমিকা অনস্বীকার্য। গাছপালা হচ্ছে প্রাণের প্রতিনিধি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাপানিরা বাগান তৈরি বা উদ্যান রচনাকে উঁচুদরের শিল্পকলা মনে করে। মাটির পৃথিবীকে ঘিরে তারা মস্ত বড় একটি ত্রিমাত্রিক পট তৈরি করে, যাতে বাসিন্দাদের মনে বস্তুগত এবং চিন্তগত অবকাশের বোধ জাগে। ইট-কাঠ তো মানুষের রাষ্ট্রিক তথা সামাজিক সংস্কৃতির ঘনীভূত চেহারা। কিন্তু জাপানিদের কাছে আকাশ মাটি গাছপালা একযোগে কথা কয়ে উঠে। আকাশ তো সর্বত্রই আছে। আকাশকে কেন আড়াল রাখা হবে। প্রান্তর যেখানে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে আকাশকে যথাসম্ভব অক্ষত রাখা দরকার। আকাশ তো শুধূ স্কাই নয়, তার অন্য একটা প্রতিশব্দ স্পেস। আকাশকে অনুভবের প্রয়োজন, যা মানুষ তথা প্রাণী মাত্রেরই রয়েছে। সেটা তার সর্বাঙ্গীন স্বাস্থ্যের পক্ষে অপরিহার্য।

নতুন যুগের বিভিন্ন নির্মিত প্রতিবেশের মধ্যে বৈচিত্র্য যতই থাকুক, এক জায়গায়; কিন্তু মিল থাকতে হবে। সেটা হলো ত্যাগ আর ভোগের সামঞ্জস্য বিধানের তাগিদ। ত্যাগের ও ভোগের সামঞ্জস্য হচ্ছে পূর্ণশক্তি। প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠলে ত্যাগের ও ভোগের সামঞ্জস্য ভেঙে যায়। নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজকের দিনে মোটেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, যথার্থ নিরাপত্তা আসে প্রতিবেশী মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে।

যা হোক পরিবেশ ও প্রতিবেশ শুধু ইট কাঠের তৈরি হলে চলবে না। তার পেছনে থাকতে হবে গোটা সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালো-মন্দ বোধ, রুচি আর আদর্শ। কিন্তু সমাজের কল্যাণকর চিন্তার মধ্যে যদি গোড়াতেই গলদ থাকে, সবকিছুকে ছাপিয়ে যদি সেখানে শুধু ভোগ-সুখ প্রাধান্য পায়, তা হলে সেই ভোগের উচ্ছিষ্টস্বরূপ আবর্জনা জমতে থাকবে। আর সেই আবর্জনা ইটের পরে ইট স্তূপীকৃত হয়ে তার মধ্যে চাপা পড়ে যাবে মানুষরূপী কীট।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, সদস্য-বন ও পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি, সিলেট