আদার বেপারি জাহাজের মালিক
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কোথাও কিছু ঘটছে। চারপাশে সারাক্ষণ গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর চলছে। গুজবের গজবে জর্জরিত সারা দেশ। জানার চেষ্টায় কৌতূহলী জনতা হাঁসফাঁস করে। তেমন কিছু জানতে না পারলে ধারণা করে রটিয়ে দেয় মনগড়া গল্প। কোনো কোনো সংস্থা ফায়দা নিতে পরিকল্পিতভাবে উত্তেজক বা রসালো তথ্য বাতাসে ছেড়ে দেয়। তারপর প্রতিক্রিয়া দেখে ক্রীড়াচর্চা করে। হরদম চলছে এ খেলা। ক্ষণে ক্ষণে মাঠ বা খেলোয়াড় পাল্টালেও ক্লান্তি নেই কোচ বা ম্যানেজারের। কোনো কোনো ঘটনার চেয়ে রটনা বেশি। ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। মূলধারার গণমাধ্যমের ব্যর্থতা আর তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ভুঁইফোঁড় এবং নকল মিডিয়া। বাকস্বাধীনতা ফিরে পাওয়ায় কথা বলার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নিচ্ছে অনেকে। সবাই সবকিছু দ্রুত হতে চাচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর এ প্রবণতা মারাত্মক হারে বেড়েছে। সরকারের অদক্ষতায় দিন দিন স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা মহামারি আকার পাচ্ছে। ঢাকার রাজপথে সামান্য অটোরিকশার দৌরাত্ম্য থামাতে পারেনি ইউনূস সরকার। জনশ্রুতি আছে, রাজধানীতে পরিকল্পিতভাবে অটোরিকশার সংখ্যা বাড়াচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের অনুমতি দিয়ে গেছেন। সেই কৃতজ্ঞতায় অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতে ভূমিকা রাখবে তারা। এটা ষড়যন্ত্র নাকি গুজব, প্রমাণিত না হলেও প্রচারিত হচ্ছে দেদার।
শুধু কি অটোরিকশা! উড়োজাহাজে চড়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি আর কে কে গেলেন মার্কিন মুল্লুকে? জাতিসংঘ অধিবেশনে তাদের কাজইবা কী? অভূতপূর্ব ও ব্যতিক্রম এ রাজনৈতিক সফর ঘিরে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। সফরসঙ্গী বিবেচনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। শেখ হাসিনার পতনের পর নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে বিভেদ দেখা দিয়েছে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে। তাদের পাশে রেখে সরকারি ব্যর্থতা এবং অনৈক্য ঢাকতে এ আয়োজন বলে মন্তব্য করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো মধ্যস্থতা বা আলোচনার জন্য এ সফর নয়।
বর্তমান সরকারের অংশীজন হিসেবে তারা নিউইয়র্ক সফরে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অংশীজন তো আরও অনেকে রয়েছেন। তারা এরই মধ্যে জানতে চাচ্ছেন, কীসের ভিত্তিতে সফরসঙ্গীর তালিকা করা হয়েছে। প্রেস সচিব অবশ্য বলেছেন, পর্যায়ক্রমে অন্যরাও যাবে। এতে আরও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বলতে কতদিন? এই অন্তর্বর্তী সরকার আরও কত মাস থাকতে পারবে বা থাকতে চায়? সরকার গঠনের শুরু থেকেই এ প্রশ্ন নানা আঙ্গিকে ঘুরেফিরে বাজছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক সম্পর্ক ও রুটিন ওয়ার্কে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি এই সরকার। নির্বাচিত সরকার ছাড়া এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এড়ানো সম্ভব নয়। এ জনমত এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক দল ও জনতা এখন নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। ইউনূস সরকারও আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। বারবার সে প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণও করিয়ে দেয় তারা। কিন্তু কোথায় যেন খটকা। একেন দেলে এই কথা বিশ্বাস করতে পারছে না অনেকে। সংশয়-সন্দেহ দূর করার উদ্যোগও নেই। সরকার ও নির্বাচন কমিশনে কেমন ঢিলেঢালা ভাব। দুশ্চিন্তা নিয়ে প্রার্থী বাছাই ও গণসংযোগ করছে বিএনপি। খোশমেজাজে মনোনয়ন ও ইসলামী জোট গঠনের পাঁয়তারা করলেও পিআরের দাবিতে দুর্যোগের হুমকি দিচ্ছে জামায়াত। এখনও নিবন্ধন পায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। নির্বাচন নিয়ে তাদের হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর গুজবের হাটখোলা হিসেবে সামনে এসেছে।
মার্কিন মধ্যস্থতায় বাংলাদেশের জাতীয় সরকার গঠন বা জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এ ভাবনায় আমজনতার আলোচনা এখন কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছে ময়দানে। এরকম বিজাতীয় উদ্যোগ নিয়ে একটি মহল আবার সন্দিগ্ধ। যদিও তারা ভারতীয় অভিভাবকত্বে গত দেড় দশক আওয়ামী লীগের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো দোষ দেখেননি। তারা অবশ্য ভারতকে বিদেশই মনে করেন না। কিন্তু সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ জুলাই অভ্যুত্থানকারী দলগুলোকে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। দেশের প্রধান দল বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বিশ্লেষকরাও এগিয়ে রাখছেন। দীর্ঘদিন নির্যাতন সহ্য করে দলটি এখনো ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। দেশি-বিদেশি এজেন্ট দিয়ে বারবার ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার।
বর্তমানে নির্বাচনের জন্য উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলছেন, এবারের নির্বাচন কঠিন হবে। তবে তার নেতাকর্মীদের মাঝে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তারা সরকারি দলের সুযোগ নিচ্ছে এবং সুবিধা ভোগ করছে। এসব দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত-এনসিপি চাঁদাবাজ-দখলবাজ বলছে বিএনপিকে। প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীকে শাস্তি দিয়ে এ অভিযোগ সত্য বলে মেনে নিয়েছে দলটি। কিন্তু জামায়াত-এনসিপির চাঁদাবাজি-তদবিরবাণিজ্য প্রকাশ্যে আসছে কম। অভিযুক্ত হলেও নামমাত্র ব্যবস্থাপত্রে বহাল থাকছে নেতৃত্ব। অব্যাহত প্রচারণায় বিএনপিকে ভবিষ্যতের ‘আওয়ামী লীগ’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছে তারা। নিজেদের প্রচারমাধ্যমের দুর্বলতা ও ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় বিএনপির নেতাকর্মীরা উপযুক্ত জবাব দাঁড় করাতে পারছে না। উপরন্তু, তাদের হাবভাবে সাধারণ মানুষ সরকারি দল মনে করে বিরক্ত হচ্ছে। মজলুম থেকে এক বছরেই জমিদারি আচরণ ফিরে পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দলটি। নির্বাচন দেরি হলে জনপ্রিয়তা কমতে থাকবে বিএনপির। এটা অনেকেই বলাবলি করছে। একই অবস্থা ড. ইউনূসের। নির্বাচন বিলম্বিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হলে বিশ্ববরেণ্য এ ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। নোবেলজয়ীর পরাজয় পৃথিবী মেনে নেবে না।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব শখ ছিল নোবেলের। এজন্য চাটুকারদের প্ররোচনায় লবিস্ট নিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অনেক ক্ষতিও করেছিলেন তিনি। না পাওয়ার খেদ গিয়ে পুরোটা পড়ে ড. ইউনূসের ঘাড়ে। যার মাশুল তাকে গুনতে হয়েছে আদালতে লোহার খাঁচায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে। এবার নোবেল নিয়ে পাগলামি করতে দেখা যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। অক্টোবর মাস প্রায় চলেই এলো। নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হবে শিগগিরই। কারা পাবেন, তা নিয়ে এখন চলছে আলোচনা। এমন সময় ঘোষণা করা হয়েছে ইগ নোবেল পুরস্কার। বিভিন্ন গবেষক দলকে মজার গবেষণার জন্য দেওয়া হয় এই ইগ নোবেল।
নোবেল কমিটির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সেপ্টেম্বরেই এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৫ সালের ইগ নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এ পুরস্কার এমন গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়, যা প্রথমে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবায়। এবার শান্তি পুরস্কার পেয়েছে জার্মান, ডাচ ও ব্রিটিশ গবেষকদের একটি দল। তারা দেখিয়েছে, এক পেগ ভদকা পান করলে মানুষের বিদেশি ভাষায় কথা বলার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পুরস্কার পেয়েছেন ভারতীয় গবেষকরা। তারা একটি জুতার র্যাক তৈরি করেছেন। যেটি দুর্গন্ধযুক্ত জুতার দুর্গন্ধ দূর করে। এই র্যাকে একটি ইউভি আলো বসিয়ে দেওয়া হয়। ইউভি আলো দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে কয়েক মিনিটের মধ্যে মেরে ফেলে। তবে ব্যাকটেরিয়া মারার পাশাপাশি এই আলো জুতাও পুড়িয়ে ফেলে। জাপানের কৃষি ও খাদ্য গবেষণা সংস্থার ডাক্তার তোমোকি কোজিমা ও তার দল জীববিজ্ঞানে পুরস্কার পেয়েছেন। তার দল দেখিয়েছে, গরুর গায়ে জেব্রার মতো কালো দাগ আঁকলে মাছি কম কামড়ায়। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল আমি স্বপ্ন দেখছি।’ এরকম মজার মজার বিভিন্ন বিষয়ে এ ব্যঙ্গ নোবেল পেয়েছে আরও কয়েকটি গবেষক দল। তবে, এই বঙ্গে এরকম বিষয় শুধু মজা হয়েই থাক। সত্যি সত্যি কোনো ব্যক্তি বা দল ব্যঙ্গের শিকার না হোক। বড় দল হিসেবে বড় মনের পরিচয় দিতে হবে বিএনপিকে। বাপ-দাদার উল্লেখযোগ্য পরিচয় নেই বলে কোনো আদার ব্যাপারী জাহাজের মালিক হতে পারবে না- এমন কথা এখন টেকে না। এখন অনেক আদার ব্যাপারী, শুধু জাহাজের খবর রাখে না; মালিকও হয়েছে। তবে, এই নতুন মালিকদের অনেকের শরীর থেকে আদার ঝাঁজালো গন্ধ আসে। শিক্ষা-রুচি-আচরণে মিষ্টি গন্ধ অর্জন করতে হয়। সেটা হলে সমস্যা কম হবে। ডেনিশ দার্শনিক ও কবি সোরেন কিয়ের্কেগার্দ বলেছেন, ‘চিন্তার স্বাধীনতাকে মানুষ কম ব্যবহার করে বলেই কথার স্বাধীনতা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া হয়।’ সরকার ও দলগুলোকে এ কথা বুঝতে হবে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারীর পতন হয়েছে। এখন কথার চেয়ে কাজ জরুরি। পরস্পরকে ফ্যাসিস্ট আসার ভয় না দেখিয়ে নিজ নিজ দল ও এলাকায় গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে।
লেখক : হেড অব নিউজ, আরটিভি
