তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা
ড. শাহ জে মিয়া
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জেন-জি তারাই, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এবং যারা তাদের বেশির ভাগ কাজ করার জন্য ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নেয়। সেই সঙ্গে আরেকটি জেনারেশন আছে। তারা হলো জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালস, যাদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে এবং এই প্রজন্ম ইন্টারনেটের সূচনাকালে বড় হয়েছে। এ দুটি প্রজন্মের কথা এ কারণে বললাম যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ প্রজন্মের মানুষই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার জনসংখ্যা। পাঁচ কোটিরও বেশি জেন-জি ভোটার এবারই প্রথম ভোট দিয়ে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পরবর্তী সরকার নির্বাচিত করতে যাচ্ছে।
আমাদের এই তরুণ প্রজন্ম দেখিয়েছে, তারা কীভাবে দোষারোপের রাজনৈতিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব জ্ঞাননির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ প্রজন্ম দেখিয়েছে, তারা কীভাবে যে কোনো পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে, নিন্দা না করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে শ্রদ্ধা করে, সংযত প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের দিকে খেয়াল রাখতে সক্ষম। এই ডিজিটাল যুগে আমাদের তরুণ সমাজ সম্ভবত সমাজব্যবস্থা ৫.০-এর ধারণার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আসুন জেনে আসা যাক, সমাজব্যবস্থা ৫.০-এর ধারণাটা কী। এটি একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ধারণা, যার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমাজ কাঠামোকে বোঝায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমাজব্যবস্থায় জনগণ সুশিক্ষিত হয় এবং সমাজ তার অর্থনীতির উদ্ভাবন, উদ্যোগ এবং কাজের গতিশীলতা বাড়াতে আধুনিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। সমাজব্যবস্থা ৫.০ হলো ধারাবাহিকভাবে সামাজিক বিবর্তনের সবচেয়ে আধুনিক পর্যায়, যেখানে সমাজব্যবস্থা ১.০ ছিল পশু শিকারনির্ভর; সমাজব্যবস্থা ২.০ ছিল কৃষিনির্ভর; সমাজব্যবস্থা ৩.০ ছিল শিল্পনির্ভর এবং সমাজব্যবস্থা ৪.০ হলো তথ্য বা ইন্টারনেটনির্ভর। অনেক গবেষক বর্তমানে সমাজব্যবস্থা ৫.০-কে ‘সুপার-স্মার্ট সোসাইটি’ও বলছেন।
সমাজব্যবস্থা ৫.০ একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থ-সামাজিকব্যবস্থার কথা বলে থাকে, যা পরিচালিত হয়ে থাকে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তিভিত্তিক কার্যকলাপের মাধ্যমে। যেমন-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, বিগ ডেটা অ্যানালিটিকস, ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এবং ক্লাউড কম্পিউটিং। যা হোক, সমাজব্যবস্থা ৫.০-এ রূপান্তরকে আমরা ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের’ সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কারণ উভয় ধারণাই আমাদের অর্থনৈতিক বিশ্বে একটি নতুন ধরনের মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তবে সমাজব্যবস্থা ৫.০ মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের থেকেও বিস্তৃত ধারণা, যা কি না পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত; কারণ এটি আমাদের এ সময়ের ডিজিটাল জীবনযাত্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন আনছে।
একটি উদাহরণ টেনে সমাজব্যবস্থা ৫.০-এর ধারণাটিকে পরিষ্কারভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। যেমন, জনশূন্য এলাকায় স্বায়ত্তশাসিত গাড়ি ও ড্রোন মানুষের কাছে পণ্য ও পরিষেবা পৌঁছে দেবে। ক্রেতারা অনলাইনে সরাসরি পোশাক কারখানা থেকে তাদের পোশাকের আকার, রং ও কাপড় বেছে নিতে পারবে এবং ড্রোন দিয়ে তা সরবরাহ নিতে পারবে। একজন চিকিৎসক স্মার্টফোনের মাধ্যমে বাড়িতে বসেই রোগীদের পরামর্শ দিতে পারবে। পাশাপাশি কোনো নার্সিং হোমে অন্য একটি রোবট বয়স্কদের সেবা প্রদানে সাহায্য করতে পারে। শহরের প্রতিটি অংশে তাদের নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটাতে স্মার্ট উপায়ে সৌর বা নবায়নযোগ্য বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করার বিষয় বলা আছে, এই প্রযুক্তিনির্ভর সমাজব্যবস্থার মধ্যে। যা হোক, এই পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার মধ্যে মানুষের আধুনিক চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সমন্বয় ঘটানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রশ্নে আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রধান দল বিএনপির সামনে। আগামী নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম হয়তো বিএনপির মধ্যে সমাজব্যবস্থা ৫.০-এর বৈশিষ্ট্য সংবলিত এজেন্ডা দেখতে চায়। এখানে ধারণা করা যেতে পারে, যদি বিএনপি সত্যিই যথাযথ রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের সমাজব্যবস্থা নিয়ে আসতে পারে, তবে তারা তাদের স্বপ্ন, আশা আর ডিজিটাল বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন পথ দেখতে পারে। এ প্রজন্ম তখন নতুন বিকল্প খোঁজার পরিবর্তে বিএনপিকে আদর্শ প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচন করবে, যারা কি না, তাদের আশা-ভরসার জায়গায় থাকবে।
এ মুহূর্তে বিএনপির উচিত বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে একত্রিত করে দলীয় সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দলীয় অবকাঠামো শক্তিশালী করা, যা দলটি এরমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে গণমানুষের এবং তরুণ প্রজন্মের চাহিদাগুলো সমন্বয় করে আসনভিত্তিক নির্বাচনি মেনিফেস্টো তৈরি করা। এই মেনিফেস্টো নিয়ে জনপ্রিয়, সৎ, ত্যাগী ও একনিষ্ঠ নেতাকে নির্বাচনে মনোনয়নের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে যাওয়া।
বিএনপির এ মুহূর্তে একমাত্র কাজ হওয়া উচিত গণমানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো, মানুষকে নিয়ে চিন্তা করা, মানুষের ভেতরে ঢুকে যাওয়া এবং প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে এবং প্রতিটি গ্রাম পর্যায়ে ১০০ জনের কমিটি করে প্রতিনিয়ত মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়া, সবার সঙ্গে কথা বলা, তাদের সমস্যা, প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা ও এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। কেন্দ্রীয় নির্বাচনি মেনিফেস্টোর সঙ্গে এলাকাভিত্তিক মেনিফেস্টোর মধ্যে স্থানীয় সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেই সমস্যার সমাধানে কী কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে কাজ করা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শিক ধারক ও বাহক এই রাজনৈতিক দলটির আইডেন্টিটি হবে এমন একটি ভাবমূর্তি, যা কিনা আসলেই তরুণ প্রজন্মের জন্য আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি এরমধ্যেই তাদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও অনলাইনে কিছু অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ প্রতিনিয়ত সংঘবদ্ধভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, ভালো কাজগুলোকেও খারাপ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করছে। এসব সমালোচনামূলক কনটেন্টের ধরন যে খুবই নেতিবাচক এবং মুখরোচক ঘটনার সমন্বয়ে কনটেন্টের ভিউ বাড়ানোর একটি প্রয়াস, তা সহজেই অনুমেয়। যদিও অতীতে এসব অ্যাক্টিভিস্ট বিভিন্নভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল এবং তারা বিএনপিকে সরাসরি সমর্থন করেছিল; কিন্তু অজানা কারণে এ মুহূর্তে তারা তাদের অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে নিয়েছে।
বিএনপির সর্বোচ্চ মহল যদি এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা না করে, তাহলে এর ক্ষতিকর প্রভাব নির্বাচনে পড়তে পারে বলে মনে করি। এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথা ভেবে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে একটি আলোচনার দরজা খোলা উচিত। প্রত্যেক নেতাকর্মীকে মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের মূল উৎস হচ্ছে সততা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা নিয়ে কাজ করা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন, যেটা পারে ডিজিটাল এই যুগে সমাজব্যবস্থা ৫.০ ধারণার বৈশিষ্ট্যগুলো বাস্তবায়ন করতে। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের জনগণ কমবেশি বিভিন্নভাবে অধিকারবঞ্চিত হয়েছিল। প্রায় ১৯ কোটি জনগণের এই দেশে এ সময় বিএনপি যদি জনগণের সেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে দলটির ভাগ্যে অনেক করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশও একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে, যেটা দেশপ্রেমিক কোনো নাগরিকেরই কাম্য নয়।
লেখক : প্রফেসর অফ বিজনেস এনালিটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড এআই, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
