বাংলাদেশের ই-কমার্সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে
মো. নূর হামজা পিয়াস
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) আজকের বিশ্বব্যাপী ব্যবসার এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং এমন একটি রূপান্তরমূলক শক্তি যা পুরো বিপণন ক্ষেত্রের চিত্রই পাল্টে দিচ্ছে। AI ব্যবসাগুলোকে গ্রাহকের আচরণ আরও গভীরভাবে বুঝতে, তাদের চাহিদা নির্ধারণ করতে এবং ব্যক্তিগতকৃত অভিজ্ঞতা প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করতে সহায়তা করছে। প্রচলিত বিপণন কৌশল যেখানে সাধারণ ও একরকম বার্তা প্রচারের ওপর নির্ভর করত, সেখানে AI গ্রাহকের প্রতিটি যাত্রা বিশ্লেষণ করে সঠিক বার্তা, সঠিক সময়ে এবং সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছে।
আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল ডিজিটাল যুগে, যেখানে গতি, ব্যক্তিগতকরণ এবং উদ্ভাবনই ব্যবসার টিকে থাকা ও প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি, সেখানে AI-এর গুরুত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহার, মোবাইল ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তার দেশের গ্রাহক আচরণে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিপণন কৌশলে AI-কে সংযুক্ত করা আর বিলাসিতা নয়, বরং টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বিপণনের মূল উদ্দেশ্য সবসময়ই ছিল গ্রাহকের চাহিদা বোঝা, সেই চাহিদা পূরণ করা এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। তবে অতীতে এটি একটি সরল প্রক্রিয়া ছিল। বিজ্ঞাপন, প্রচারপত্র, টিভি বা রেডিও বিজ্ঞাপন এবং ব্যক্তিগত বিক্রয়কৌশলই ছিল প্রধান মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে গ্রাহকের আচরণ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
আজকের গ্রাহকরা স্মার্টফোনে একটি ক্লিকেই পণ্য তুলনা করতে পারে, তাৎক্ষণিকভাবে রিভিউ পড়তে পারে এবং একইসাথে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে। ফলে গ্রাহকদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। তারা দ্রুত সাড়া চায়, ব্যক্তিগত পরিষেবা চায় এবং একটি নির্বিঘ্ন অভিজ্ঞতা চায়। প্রচলিত বিপণন এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ই-কমার্স এবং ডিজিটাল পরিষেবার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, সেখানে ব্যবসাগুলোকে আরও ডেটা-ভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কার্যকর সমাধান হলো AI-চালিত গ্রোথ মার্কেটিং।
গ্রোথ মার্কেটিং প্রচলিত বিপণনের চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র গ্রাহক আকর্ষণের দিকে নয়, বরং গ্রাহকের সম্পূর্ণ যাত্রার প্রতিটি ধাপে মনোযোগ দেয়। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা পাঁচটি ধাপে বিভক্ত যেমন: নতুন গ্রাহক অর্জন, গ্রাহককে সক্রিয় করা, গ্রাহক ধরে রাখা, রাজস্ব বৃদ্ধি এবং গ্রাহকের মাধ্যমে নতুন গ্রাহক আনা।
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে গ্রোথ মার্কেটিং-এর গুরুত্ব এখন অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, দেশের ই-কমার্স খাতে ২০২৫ সালে মোট বিক্রয় ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী সংখ্যা ১১.৫ কোটি ছাড়িয়েছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৭ কোটিরও বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এই বিশাল অনলাইন গ্রাহকভিত্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য ব্যবসাগুলোকে অবশ্যই ডেটা-নির্ভর গ্রোথ মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ করতে হবে। AI-এর অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো গ্রাহকের ডেটা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা।
প্রতিদিন অসংখ্য গ্রাহক অনলাইনে ব্রাউজ করছে, কেনাকাটা করছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতামত দিচ্ছে। AI এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে গ্রাহকের আচরণ, পছন্দ, এবং কেনাকাটার ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম AI ব্যবহার করে গ্রাহকের ব্রাউজিং ইতিহাস থেকে ব্যক্তিগতকৃত পণ্যের সুপারিশ তৈরি করতে পারে। কেউ যদি নিয়মিত পোশাকের পৃষ্ঠায় যান, তবে সেই গ্রাহকের জন্য পোশাক সম্পর্কিত নতুন অফার বা ছাড়ের নোটিফিকেশন পাঠানো হবে। এতে গ্রাহকের কেনাকাটার সম্ভাবনা ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিশ্বব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগতকৃত বিপণনের মাধ্যমে বিক্রয় গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। একইসাথে, গ্রাহক সন্তুষ্টিও বাড়ে এবং গ্রাহক বিশ্বস্ততা দৃঢ? হয়।
AI-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো চ্যাটবট এবং ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসা ইতিমধ্যে AI-চালিত চ্যাটবট ব্যবহার করছে, যা ২৪ ঘণ্টা গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গ্রাহক যদি মধ্যরাতে কোনো পণ্যের স্টক সম্পর্কে জানতে চান, তবে চ্যাটবট সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারে। এটি শুধু গ্রাহকের সময় বাঁচায় না, বরং ব্যবসার কর্মী ব্যয়ও কমায়। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ গ্রাহক মনে করেন যে দ্রুত এবং নির্ভুল উত্তর তাদের কেনাকাটার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। AI চ্যাটবট এই চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
AI কেবল গ্রাহক চিহ্নিত করা বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নয়, বরং প্রমোশনাল কার্যক্রমের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, AI বিশ্লেষণ করতে পারে কোন সময়ে কোন পণ্য প্রচার করলে সর্বাধিক বিক্রয় হবে। বাংলাদেশের উৎসবমুখর সময় যেমন ঈদ বা পূজা, সেই সময়ে গ্রাহকের কেনাকাটার প্রবণতা সর্বোচ্চ থাকে। AI এই ডেটা বিশ্লেষণ করে সঠিক সময়ে সঠিক অফার প্রদান নিশ্চিত করে। ফলে বিজ্ঞাপন খরচ কমে এবং বিক্রয় বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, AI-চালিত প্রমোশনাল কৌশল ব্যবহার করলে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ROI বা বিনিয়োগের রিটার্ন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
Generative AI এখন বিপণন ক্ষেত্রের অন্যতম বড় পরিবর্তন আনছে। এটি এমন এক ধরনের AI যা নতুন কনটেন্ট যেমন লেখা, ছবি, ভিডিও এমনকি সংগীতও তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের ছোট ব্যবসাগুলো এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের বিপণন কার্যক্রমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। আগে যেখানে পণ্যের বর্ণনা লিখতে বা বিজ্ঞাপন তৈরিতে পেশাদারদের নিয়োগ করতে হতো, এখন Generative AI ব্যবহার করে সেকেন্ডের মধ্যে মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করা সম্ভব। বাংলা ভাষায় কনটেন্ট তৈরি করার ক্ষমতা ছোট ব্যবসার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। এর ফলে স্থানীয় বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত, আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। আগে ব্যবসাগুলো ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করত। এতে বাজারের দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু AI-এর মাধ্যমে এখন রিয়েল-টাইম ডেটা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যবসাগুলো প্রতিযোগীদের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে অও ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিযোগী কোম্পানির মূল্য নির্ধারণ, গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া এবং প্রমোশনাল কৌশল তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। এর ফলে ব্যবসা তাদের নিজেদের কৌশল দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে এবং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারে।
গ্রাহককে ধরে রাখা নতুন গ্রাহক অর্জনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন গ্রাহক অর্জনের খরচ বিদ্যমান গ্রাহক ধরে রাখার তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। AI গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করতে পারে কোন গ্রাহক চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এরপর তাদের জন্য বিশেষ অফার, লয়ালটি প্রোগ্রাম বা ব্যক্তিগতকৃত বার্তা পাঠানো হয়। এতে গ্রাহক সন্তুষ্টি বাড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্রাহক আনুগত্য শক্তিশালী হয়। যদিও AI-এর সুযোগ অনেক, বাস্তবায়নে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দক্ষ AI বিশেষজ্ঞের অভাব। এছাড়াও, ডেটা গোপনীয়তা সম্পর্কিত নীতি এখনও দুর্বল। উদাহরণস্বরূপ, অনেক গ্রাহক এখনও মনে করেন তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত নয়। এই আস্থার অভাব ব্যবসার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে।
এছাড়াও, AI সিস্টেম স্থাপন করতে প্রাথমিকভাবে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। ছোট ব্যবসাগুলোর জন্য এটি একটি বড় বাধা। তাই, সরকার ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে AI প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য হয় এবং ছোট ব্যবসারাও এটি ব্যবহার করতে পারে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও উন্নত ও বৈচিত্র্যময় হবে। ভয়েস-চালিত বিপণন, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ, এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR)-এর সমন্বয় গ্রাহকদের অভিজ্ঞতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য এটি একটি বিশাল সুযোগ। সঠিক নীতি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও নেতৃত্ব দিতে পারে।
AI এখন আর কোনো দূরবর্তী স্বপ্ন নয়, বরং বাংলাদেশের ব্যবসার প্রতিদিনের বাস্তবতা। এটি ব্যবসাগুলোকে ডেটা-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে, গ্রাহকের চাহিদা বুঝতে এবং ব্যক্তিগতকৃত অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম করছে। যারা AI দ্রুত গ্রহণ করবে, তারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। আর যারা পরিবর্তনকে এড়িয়ে চলবে, তারা পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে। বাংলাদেশের ব্যবসার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মানবীয় সৃজনশীলতা এবং AI প্রযুক্তির শক্তিশালী সমন্বয়ের ওপর। ডিজিটাল যুগে গ্রোথ মার্কেটিং এবং AI-এর সমন্বয় বাংলাদেশের ব্যবসাকে বৈশ্বিক মঞ্চে এক নতুন পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। এখনই সময় সঠিক কৌশল গ্রহণ করে দেশের অর্থনীতিকে প্রযুক্তি-নির্ভর, টেকসই এবং প্রতিযোগিতামূলক রূপে গড়ে তোলার।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
