কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতি যদি তার শিক্ষাব্যবস্থা দৃঢ় এবং কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই জাতির প্রগতির ভিত্তিই শিথিল হয়ে যায়। বাংলাদেশে শিক্ষার বর্তমান বাস্তবতা দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটের মধ্যে আছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসরকারি স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান এখনও প্রত্যাশিত স্তরে পৌঁছায়নি। একদিকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের অশান্তি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষার উপর অযত্ন, অন্যদিকে অভিভাবকের অতিরিক্ত প্রত্যাশা, প্রতিযোগিতামূলক চাপ এবং শিক্ষার্থীর মেধা-বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা- এসব কারণে শিক্ষার্থীরা বিকল্প পথ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। সেই বিকল্প পথ হলো কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট টিউশন। আজ এই কোচিং সংস্কৃতি বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক প্রকার নতুন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে বিতর্কও তীব্র- কেউ মনে করেন এটি শিক্ষার প্রয়োজনীয় সহায়ক ব্যবস্থা, অন্যরা এটিকে নিছক বাণিজ্যিক শোষণ।

কোচিং সেন্টারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে যে কারণগুলো কাজ করছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মূলত স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। স্কুলে শিক্ষার মান অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ভারসাম্যহীন, পাঠদান প্রক্রিয়া অপ্রতুল। শিক্ষকরা অনেক সময় যথাযথভাবে পাঠদান করেন না, ফলে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে শিক্ষকের কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য নেয়। এই প্রক্রিয়ায় কোচিং একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বড় শহরগুলোতে কোচিং ব্যবসা এতই বিস্তৃত যে শিক্ষার্থীরা স্কুলের ক্লাসে সময় দেওয়ার পরিবর্তে কোচিং সেন্টারে বেশি সময় ব্যয় করে। প্রাইভেট টিউশনও একইভাবে শিক্ষার্থীর বাড়তি সহায়তার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করছে।

কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি হলো, অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে পাঠ্যক্রমে দুর্বল থাকে, কোচিংয়ের মাধ্যমে তারা সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে। পরীক্ষা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশেষ কৌশল শেখা প্রয়োজন, যা স্কুলে সম্ভব নয়। এছাড়া কিছু মানসম্মত কোচিং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর পড়াশোনাকে আরও কার্যকর করে। ডিজিটাল উপকরণ, মডেল টেস্ট, প্রশ্নব্যাংক- এসব শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিকে গতিশীল করে। অভিভাবকরা স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কোচিংকে প্রয়োজন মনে করেন।

কিন্তু সমস্যার আরেকটি মাত্রা হলো শোষণ। কোচিং এখন কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বড় শহরে বিশাল ভবন, ব্যানার, বিজ্ঞাপন- সব মিলিয়ে এটি একটি কর্পোরেট শিক্ষা শিল্পে পরিণত। শিক্ষার্থীরা গ্রাহক, অভিভাবকরা বিনিয়োগকারী, আর শিক্ষকরা সেবাদাতা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য- জ্ঞানের বিকাশ- বিপন্ন হচ্ছে। এখানে লক্ষ্য কেবল পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন। শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে প্রশ্ন সমাধান শিখছে, কিন্তু বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা অর্জন করছে না।

শিক্ষকদের নৈতিক সংকটও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সম্পূর্ণ মনোযোগ না দিয়ে কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনে শিক্ষার্থীর দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগ দেন, কারণ সেখানে আর্থিক লাভ বেশি। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়, শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ সমাজের জন্যও ক্ষতিকর। শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত চাপের মধ্যে পড়ে, মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, শৈশব ও কৈশোর প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধনী পরিবার কোচিংয়ে বেশি টাকা খরচ করতে সক্ষম, দরিদ্র পরিবার পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষার মাধ্যমে সমতা প্রতিষ্ঠার সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল সাফল্য, নম্বর অর্জন, পরীক্ষা পাসে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য বিপজ্জনক।

যদিও সবকিছু নেতিবাচক নয়। অনেক কোচিং শিক্ষার্থীর জন্য সহায়ক। যারা দুর্বল, তাদেরকে ব্যক্তিগত মনোযোগ এবং সহায়তা দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৌশল শেখা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তবে এটি সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। যখন কোচিং বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, তখন এটি সমস্যা তৈরি করে। বর্তমানে এই সীমা অতিক্রম করেছে। স্কুলের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীর কাছে গৌণ হয়ে গেছে; আসল পড়াশোনা হচ্ছে কোচিং সেন্টারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং এমনকি জাপানেও কোচিং সেন্টারের বিস্তার ঘটেছে। ভারতে ‘কোটা’ শহরকে কোচিং কেন্দ্র বলা হয়, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভর্তি হয়। জাপানে জুকু নামে কোচিং আছে, যেখানে শিশুরা স্কুল শেষে রাত অবধি পড়াশোনা করে। এই সংস্কৃতি শিক্ষার্থীর শৈশব ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সমাধানের পথ পরিষ্কার। প্রথমত, শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকরা যদি আন্তরিকভাবে ক্লাস নেন, শিক্ষার্থীরা যদি সেখানে পর্যাপ্ত কিছু শিখতে পারে, তবে কোচিংয়ের উপর নির্ভরতা কমবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা বাধ্য হয়ে কোচিং ব্যবসায় না লিপ্ত হন। তৃতীয়ত, কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে- নিবন্ধন, ফি, কার্যক্রম এবং সময়সীমা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। চতুর্থত, শিক্ষানীতি সংস্কার দরকার- পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা বাদ দিয়ে সৃজনশীলতা, গবেষণা এবং বিশ্লেষণধর্মী শিক্ষায় জোর দিতে হবে। পঞ্চমত, অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে; সন্তানকে অযথা কোচিংয়ে চাপিয়ে শৈশবকে কষ্ট দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

অতএব, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন একদিকে শিক্ষার সহায়ক, অন্যদিকে শোষণের হাতিয়ার। এটি সম্পূর্ণ ভালো বা সম্পূর্ণ খারাপ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়া এটি সমাজের জন্য হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জন, চরিত্র গঠন এবং সৃজনশীল চিন্তা বিকাশ, আর ব্যবসার পণ্য বানানো নয়। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা কি শিক্ষাকে আলোকবর্তিকা হিসেবে চাই, নাকি ব্যবসার মাধ্যমে নম্বর ও মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে স্বীকার করি। কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশনের প্রসার ইতিবাচক দিক থাকলেও বাস্তবে এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক চাপ বাড়াচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি করছে এবং শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে অবমূল্যায়ন করছে। দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিটি স্তরে পড়তে পারে। শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ- সবকিছুই বিপন্ন হচ্ছে। শিক্ষা যদি শুধুমাত্র পরীক্ষার নম্বর অর্জনের মাধ্যম হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং নেতৃত্ব কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়বে। এই সংকট মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। শিক্ষাব্যবস্থা, সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক ও কোচিং প্রতিষ্ঠান- সবকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। কোচিংকে সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে দায়িত্বশীল হোন, অভিভাবকরা সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করুন, সরকার কার্যকর নীতি প্রণয়ন করুক এবং শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সৃজনশীলভাবে শেখার প্রতি মনোযোগ দিন।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন আজকের শিক্ষাব্যবস্থার এক বাস্তবতা। তবে বাস্তবতা চিহ্নিত করতে পারলে আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর মেধা, মনন ও চরিত্র গঠনের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত আলোকবর্তিকা, ব্যবসার পণ্য নয়। আমাদের দায়িত্ব হলো এই বাস্তবতাকে সমাধানের পথে নিয়ে যাওয়া, যাতে কোচিং শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা হত্যা না করে, বরং শিক্ষার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার্থীর সাফল্য কেবল নম্বর বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার দক্ষতা, চিন্তাশক্তি, মানসিক প্রস্তুতি ও সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে ফুটে ওঠে। কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন যদি শিক্ষার্থীর বিকাশের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে, তবে তা হবে একটি ইতিবাচক সংস্কৃতি। কিন্তু যখন এটি আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নয়, বরং বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থী শুধু নম্বর বা ফলাফলের জন্য পড়াশোনা করছে, সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিক মূল্যবোধ পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলো পিছিয়ে পড়ছে, ধনী শিক্ষার্থীরা সুবিধা পাচ্ছে- ফলে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে সমতার ধারণা বিলীন হচ্ছে।

লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, আমদিরপাড়া