ইটভাটার ধোঁয়া থেকে ফসল ও কৃষককে বাঁচান
মো: শামীম মিয়া
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও মূলস্তম্ভ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ এলাকায় ইটভাটার সংখ্যা অসামঞ্জস্যভাবে বেড়ে গেছে। নদীঘেঁষা উর্বর জমি এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ইটভাটার অযৌক্তিক বিস্তার কৃষকের জীবন ও উৎপাদনশীলতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ইটভাটার ধোঁয়া শুধু পরিবেশ দূষণই ঘটাচ্ছে না, এটি কৃষকের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গ্রামীণ এলাকায় প্রচলিত অনেক ইটভাটা এখনও হস্তচালিত বা অপ্রযুক্তিগতভাবে পরিচালিত হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ, কয়লা, কচুরিপানা, কখনও কখনও বর্জ্য। এই জ্বালানিতে প্রচণ্ড ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, ফসলের পাতা, মাটি এবং স্থানীয় জলাশয়কে আক্রান্ত করে। সূর্যের আলো কমে যাওয়ায় ফটোসিনথেসিস প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এর ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন হ্রাস পায়।
শীতকালীন শাকসবজি, ডালজাতীয় ফসল এবং পাট বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকা ধান এবং ফলের মানও ধোঁয়ার কারণে হ্রাস পায়, যা বিক্রির মূল্যকে প্রভাবিত করে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষকের আয়ের হ্রাস সরাসরি পরিবারের জীবনমানের সঙ্গে জড়িত। ফসল নষ্ট হলে ঋণ, দৈনন্দিন জীবনযাপন ব্যাহত এবং ভবিষ্যৎ অস্থির হয়ে পড়ে।
স্বাস্থ্যগত প্রভাবও মারাত্মক। ইটভাটার ধোঁয়ায় রয়েছে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান যেমন- কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড এবং ক্ষুদ্র কণিকা। দীর্ঘমেয়াদে এ ধোঁয়া ফুসফুসের রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, চোখের সমস্যা এবং অ্যালার্জি বৃদ্ধি করে। শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, ধোঁয়াযুক্ত এলাকায় শ্বাসনালি রোগের হার অন্য অঞ্চলের তুলনায় দ্বিগুণ।
স্বাস্থ্য খরচ বেড়ে যাওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে জড়িত। অসুস্থ কৃষক উৎপাদন করতে পারছেন না, পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হচ্ছে। পরিবেশগত প্রভাবও গভীর। ধোঁয়া স্থানীয় বাতাস ও জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট করছে। স্থির বাতাসের সময় ধোঁয়া জমা হয় এবং গ্রামীণ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মৌমাছি, পোকামাকড় এবং স্থানীয় প্রাণিজগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা পরাগায়ন প্রক্রিয়ার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাটির উর্বরতা কমছে, অমøতার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, এবং মাটির স্বাস্থ্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কম ফলন, কম বিক্রয় এবং অসুখজনিত ক্ষতি তাদের আয়কে প্রভাবিত করছে।
অনেক কৃষক ঋণে জড়াচ্ছেন, কেউ কেউ জীবনধারা পরিবর্তনের পথে বাধ্য হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জন্য ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, রংপুর ও ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলে প্রতি বছর ১০-১৫ শতাংশ ফসল ধোঁয়ার কারণে নষ্ট হচ্ছে। সমাধান অবশ্য অসম্ভব নয়।
প্রথম পদক্ষেপ হলো- ইটভাটার আধুনিকীকরণ। প্রচলিত হস্তচালিত ভাটার পরিবর্তে উচ্চ কার্যক্ষম, কম ধোঁয়া উৎপাদনকারী চুল্লি ব্যবহার করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং সঠিক পরিচালনার উপর নজর রাখতে পারে। আধুনিক চুল্লি ব্যবহারে জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব, যা মালিকের জন্যও লাভজনক।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো ইটভাটার অবস্থান নিয়ন্ত্রণ। কৃষিজমির পাশে ইটভাটা স্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল, দূষণবর্জিত অঞ্চল বা শহরের পাশে ভাটা স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত দূষণ পরিমাপ এবং পরিবেশ মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
তৃতীয় পদক্ষেপ হলো ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য আর্থিক সহায়তা। ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ত্রাণ, বিমা বা ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে, কৃষক ও ইটভাটা মালিকদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ‘পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন’ নীতি চালু করা যেতে পারে।
চতুর্থ পদক্ষেপ হলো সচেতনতা বৃদ্ধি। মিডিয়া, গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় কমিটি সচেতনতা প্রচারণা চালালে কৃষকরা তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জানবেন। সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যা দ্রুত সমাধান সম্ভব।
পঞ্চম, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন। গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদনের নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার ও প্রয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার, ধোঁয়া কমানো প্রযুক্তি এবং আধুনিক ভাটার প্রয়োগ কৃষি ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই লাভজনক।
আইনগত দিক থেকেও পদক্ষেপ জরুরি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের জরিমানা, স্থগিতাদেশ বা ভাটার পরিচালনা বন্ধের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যভাবে তাদের অধিকার রক্ষা করতে পারেন, সেই জন্য স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ সংস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিকভাবে, কৃষকরা প্রায়শই অসহায় বোধ করেন। সরকার, সমাজ এবং ইটভাটা মালিকদের সহযোগিতায় একটি সমন্বিত সমাধান তৈরি করা যায়। এতে শুধু ফসলের ক্ষতি কমবে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।
ময়মনসিংহ ও রংপুরের কিছু গ্রামের উদাহরণ অনুসারে আধুনিক ভাটা চালু করার পর ধোঁয়া উৎপাদন কমেছে, ফসলের ক্ষতি হ্রাস পেয়েছে, এবং কৃষকরা আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়েছে। এই সফল মডেল অন্যান্য অঞ্চলেও প্রয়োগযোগ্য। পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। প্রতি ধোঁয়াযুক্ত ইটভাটা বছওে ১৫-২০ শতাংশ ফসল ক্ষতি ঘটাচ্ছে। শীতকালে ধোঁয়ার ঘনত্ব বেড়ে গেলে ক্ষতির হার আরও বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্যজনিত রোগের কারণে স্থানীয় স্বাস্থ্য খরচও বাড়ছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক সমন্বয় অপরিহার্য। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কৃষক সমিতি এবং ইটভাটা মালিকদের মধ্যে সংলাপ তৈরি করতে হবে। সবাই যদি সমাধানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে স্থায়ী সমাধান সম্ভব। আমরা চাই একটি স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং ফলনশীল কৃষি পরিবেশ। সূর্যের আলো, সুষম বৃষ্টিপাত, স্বাস্থ্যকর বাতাস এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি কৃষকের সহযোগী হবে। ইটভাটার ধোঁয়া থেকে কৃষককে রক্ষা করা মানে জাতীয় অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা। ইটভাটার ধোঁয়া শুধু ফসলের ক্ষতি করে না, এটি গ্রামীণ জীবনের নীতি, মানুষের স্বাস্থ্য এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে। প্রতিটি ধোঁয়াযুক্ত ইটভাটা আমাদের কৃষকের স্বপ্নকে ঝলসে দিচ্ছে, তাদের কঠোর পরিশ্রমকে অর্থহীন করে তুলছে। ফসলের ক্ষতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং আর্থিক অসহায়তা- এগুলো শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সংকট। আমরা চাই এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে কৃষক নিরাপদ পরিবেশে ফসল উৎপাদন করবে, সুস্থ থাকবে, এবং দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। আধুনিক প্রযুক্তি, পরিকল্পিত ইটভাটা, সচেতন সমাজ, শক্তিশালী আইন এবং আর্থিক সহায়তার সমন্বয়ই এটি সম্ভব করতে পারে। শুধুমাত্র একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা ধোঁয়া মুক্ত, উর্বর এবং স্বাস্থ্যকর গ্রামীণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি।
এটি এখন আর সময়ক্ষেপণ নয়; এটি এখন আমাদের দায়িত্ব। সরকারের নীতি, স্থানীয় প্রশাসন, ইটভাটা মালিক এবং কৃষক- সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের সচেতনতা, উদ্যোগ এবং সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, প্রতিটি কৃষকের ঘরে সূর্যের আলো প্রবাহিত হবে, বায়ু পরিষ্কার থাকবে, এবং তাদের স্বপ্ন যেন ধোঁয়ার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কৃষককে বাঁচানো মানে দেশের ভবিষ্যত বাঁচানো। আজই পদক্ষেপ নিন- যেন আমাদের ফসল, আমাদের খাদ্য, আমাদের গ্রামীণ সমাজ এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সুরক্ষিত থাকে। এটি শুধুমাত্র একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
লেখক : শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা।
