জীবনকে ভালোবাসতে হৃদয়ের যত্ন নিন

ড. হৃদয় আনসারী

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২৫। প্রতিবছর এ দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় হৃদরোগ বা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (CVD) সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে। বিশ্বজুড়ে অকালমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এ হৃদরোগ; যা প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এ বছর বিশ্ব হার্ট দিবসের থিম হলো-‘ Don't Miss a Beat’ (একটি স্পন্দনও মিস করবেন না)। এ থিমটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি হৃদয়ের গুরুত্ব এবং এর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের একটি জরুরি বার্তা দেয়। হৃদরোগের নীরব ঘাতক থেকে নিজেকে বাঁচাতে হলে, প্রতিটি স্পন্দনকে মূল্য দিতে হবে, কোনো সতর্কীকরণ সংকেতকে উপেক্ষা করা চলবে না।

হৃদরোগ এক বৈশ্বিক মহামারি : কার্ডিওভাসকুলার রোগ (CVD) হলো হার্ট ও রক্তনালি সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগের একটি সম্মিলিত রূপ, যার মধ্যে রয়েছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট ফেইলিউর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, হৃদরোগ আজও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। দুঃখজনকভাবে, এ মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। বাংলাদেশেও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো- অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও পরিবেশদূষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগের ঝুঁকি কেবল বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সি মানুষের মধ্যেও অকালমৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অর্থ হলো, তরুণ প্রজন্মও এখন এ রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের জীবনযাত্রার ধরন যেভাবে বদলে যাচ্ছে, তাতে এ ঝুঁকি আরও বাড়ছে। ফাস্টফুড, চিনিযুক্ত পানীয়, অপর্যাপ্ত ঘুম এবং অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমণ্ডএসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব আমাদের হৃদযন্ত্রের ওপর মারাত্মক চাপ ফেলছে। এবারের থিম ‘ডোন্ট মিস আ বিট’ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জোর দিতে বলছে, সতর্ক থাকুন, অনেকেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের প্রাথমিক উপসর্গগুলো বুঝতে পারেন না বা উপেক্ষা করেন। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘাম হওয়া, বাম হাত বা কাঁধে তীব্র যন্ত্রণা, হঠাৎ ভারসাম্য হারানো, কথা জড়িয়ে যাওয়া-এগুলো হলো হৃদরোগের গুরুতর সতর্কীকরণ সংকেত। এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে একমুহূর্তও দেরি না করে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। হৃদরোগে আক্রান্ত অনেক মানুষের মৃত্যু হয় শুধু দেরিতে হাসপাতালে পৌঁছানোর কারণে।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন : হৃদরোগ প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হলো জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন। খাদ্য তালিকায় ফল, সবজি, আস্ত শস্যদানা এবং চর্বিহীন প্রোটিন অন্তর্ভুক্ত করুন। অতিরিক্ত লবণ, চিনি এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের শারীরিক কার্যকলাপ (যেমন দ্রুত হাঁটা বা সাঁতার কাটা) হৃদযন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। অলসতা ত্যাগ করে সক্রিয় জীবনযাপন শুরু করা উচিত। ধূমপান ও তামাক সেবন হলো হৃদরোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। ধূমপান সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করা আপনার হৃদয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা হৃদরোগের প্রধান কারণ।

নিয়মিত পরীক্ষা : আপনার ব্লাড প্রেসার (রক্তচাপ), কোলেস্টেরলের মাত্রা এবং রক্তের গ্লুকোজ বা সুগার নিয়মিত পরীক্ষা করানো জরুরি। উচ্চ রক্তচাপকে প্রায়ই নীরব ঘাতক বলা হয়, কারণ এর কোনো স্পষ্ট উপসর্গ থাকে না। কিন্তু এটিই হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুঁকি চিহ্নিত করা যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ : বর্তমান দ্রুতগতির জীবনে মানসিক চাপ একটি অনিবার্য বাস্তবতা। তবে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ আমাদের হৃদযন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যোগা, মেডিটেশন, শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম, শখের পেছনে সময় দেওয়া এবং পর্যাপ্ত ঘুম (প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা) মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সুস্থ মনই সুস্থ হৃদয়ের ভিত্তি।

আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব : হৃদরোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেবল ব্যক্তি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি করা, নিয়মিত একসঙ্গে হাঁটতে যাওয়া এবং একে অন্যের প্রতি মানসিক সমর্থন হৃদয়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। কর্মক্ষেত্রে হাঁটা বা সিঁড়ি ব্যবহারকে উৎসাহিত করা, ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য বিরতি দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। হৃদরোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি বাড়ানো, বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সুলভে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বিশ্ব হার্ট দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, হৃদযন্ত্র হলো আমাদের জীবনের মূল চালিকাশক্তি। ‘ডোন্ট মিস আ বিট’-এ বার্তাটি গ্রহণ করে প্রতিটি মানুষকে তার হৃদয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। আসুন, আমরা সবাই সচেতন হই, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি এবং আমাদের চারপাশের মানুষের হৃদয়ের স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিই। একটি সুস্থ হৃদয় মানে একটি দীর্ঘ ও হাসিখুশি জীবন। হৃদয়ের সুরক্ষাই হোক আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।

লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক