বিশ্ব প্রবীণ দিবস : প্রয়োজন প্রবীণদের দীর্ঘমেয়াদি সেবা
ডা. মহসীন কবির
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ১ অক্টোবর, বিশ্ব প্রবীণ দিবস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের ঊর্ধ্ব প্রবীণ জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি। আগামী দুই দশকে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিবর্তিত জনমিতিক বাস্তবতা আমাদের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করছে। যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে প্রবীণদের পরিচর্যার ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। শহরমুখী অভিবাসন, কর্মব্যস্ততা এবং আধুনিক জীবনযাত্রার চাপে অনেক পরিবারই প্রবীণ সদস্যদের যথাযথ সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
লংটার্ম কেয়ার কি এবং কেন প্রয়োজন : লংটার্ম কেয়ার বা দীর্ঘমেয়াদি সেবা হলো- এমন একটি সমন্বিত সেবাব্যবস্থা যা প্রবীণদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সহায়তা প্রদান করে। এতে রয়েছে চিকিৎসাসেবা, শারীরিক পরিচর্যা, পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং সামাজিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, আর্থ্রাইটিস এবং ডিমেনশিয়া দেখা দেয়। এসব রোগের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা ছাড়া প্রবীণদের জীবনমান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক প্রবীণ নিঃসঙ্গতা এবং বিষণ্ণতায় ভোগেন, যা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশে প্রবীণ সেবার বর্তমান অবস্থা : আমাদের দেশে প্রবীণসেবা ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট উন্নত নয়। সরকারি উদ্যোগে কিছু প্রবীণ নিবাস রয়েছে, তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বেসরকারি পর্যায়ে কিছু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠলেও সেগুলোর অনেকেই মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বা প্রবীণ চিকিৎসা বিভাগ অত্যন্ত সীমিত। প্রশিক্ষিত জেরিয়াট্রিশিয়ান, জেরিয়েট্রিক ফিজিওথেরাপিস্ট এবং বিশেষায়িত নার্সের অভাব রয়েছে। প্রবীণদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ফিজিওথেরাপি সুবিধা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতাও অপ্রতুল।
দীর্ঘমেয়াদি সেবা নিশ্চিতকরণে যা করা যেতে পারে- স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ : প্রতিটি জেলায় প্রবীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে জেরিয়াট্রিক বিভাগ চালু করতে হবে। চিকিৎসক, নার্স ও কেয়ার গিভারদের প্রবীণ সেবায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
কমিউনিটিভিত্তিক সেবা মডেল : বাড়িতে থেকেই প্রবীণরা যেন মানসম্মতসেবা পেতে পারেন, সে জন্য হোম কেয়ার সেবা চালু করা প্রয়োজন। ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে প্রবীণদের সামাজিক মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
আর্থিক সুরক্ষা জোরদারকরণ : বয়স্ক ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সর্বজনীন কভারেজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবীণদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য বিমা চালু করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত প্রবীণ নিবাস গড়ে তোলা যেতে পারে।
প্রযুক্তির ব্যবহার : টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে প্রবীণরা ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারবেন। জরুরিসেবার জন্য হেল্পলাইন চালু করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য সহজ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি : প্রবীণদের প্রতি সম্মান ও যত্নশীল মনোভাব তৈরিতে গণসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের প্রবীণ পরিচর্যায় প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
সম্মিলিত দায়িত্ব ও প্রত্যাশা : প্রবীণসেবা শুধু সরকার বা পরিবারের একার দায়িত্ব নয়, এটি সমাজের সমষ্টিগত দায়িত্ব। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট সেক্টর সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে প্রবীণ কল্যাণে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের প্রবীণরা জীবনভর পরিবার ও সমাজের জন্য অবদান রেখেছেন। তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে সম্মান ও মর্যাদার সাথে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য।
বিশ্ব প্রবীণ দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আসুন আমরা অঙ্গীকার করি, একটি প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যেখানে বয়স্ক নাগরিকরা নিরাপদ, স্বাস্থ্যবান এবং সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারবেন। সময় এসেছে কথা থেকে কাজে রূপান্তরিত হওয়ার- গড়ে তুলতে হবে একটি টেকসই ও সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি প্রবীণসেবা ব্যবস্থা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক উপ-পরিচালক, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ রিটায়ারমেন্ট হোমস এন্ড হসপিটাল
(জেবিএফআরএইচ)
