আন্তর্জাতিক কফি দিবস আজ

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কফি দিবস পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক কফি সংস্থা (আইসিও) ২০১৪ সাল থেকে ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক কফি দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে ইতালিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কফি দিবস উদযাপিত হয়। আন্তর্জাতিক কফি দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- “Take Collaboration for Collective Action” (সামগ্রিক পদক্ষেপের জন্য সহযোগিতা গ্রহণ করুন)। এই প্রতিপাদ্যটি বীজের অঙ্কুরোদগম থেকে শুরু করে একটি কাপ পর্যন্ত পুরো কফি শৃঙ্খলজুড়ে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাইকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। এর মাধ্যমে ন্যায্য আয়, শক্তিশালী সম্প্রদায় এবং একটি টেকসই কফি শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এই দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে কফির জনপ্রিয়তা, এর চাষ ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো এবং কফি সম্পর্কিত বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা হয়। কফি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর বিশাল প্রভাব রয়েছে, তাই এই দিবসটির মাধ্যমে কফি উৎপাদনকারী দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়তা করা হয়।

প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে পান করা হয় কোটি কোটি কাপ কফি। দিনের শুরু হোক বা আড্ডা বা আলাপ আলোচনা, কফি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ২.২৫ বিলিয়ন বা ২২২ কোটি কাপ কফি পান করা হয়। তবে, এই সংখ্যাটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে এবং বিভিন্ন উৎস বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখাতে পারে। পানীয় হিসাবে কফি রয়েছে বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ব্রাজিলে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কফির উৎপাদন হলেও, কফি পানের দিক থেকে এগিয়ে ফিনল্যান্ডের মানুষ।

কফির আবিষ্কার হয় ইথিওপিয়ার চেরি গাছ থেকে, যেখানে এক মুসলিম রাখাল প্রথম কফি বীজ আবিষ্কার করেন। ইথিওপিয়ার কাফা নামক একটি অঞ্চলে এই গাছের দেখা মেলে এবং সেই থেকে কফির যাত্রা শুরু হয়। কফি আবিষ্কার নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প আছে- যেখানে ইথিওপিয়ার এক মেষপালক কালদি, লক্ষ্য করেন যে তার ছাগলগুলো একটি বিশেষ গুল্মের ফল খাওয়ার পর অনেক বেশি উদ্যমী ও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই পর্যবেক্ষণের পর কালদি নিজেও সেই ফল চেখে দেখেন এবং একই রকম প্রভাব অনুভব করেন। পরবর্তীতে, এ গল্পটি ইথিওপিয়া থেকে আরব দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং কফির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বে কফি উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হলো- ব্রাজিল, যা বিশ্ব সরবরাহের একটি বড় অংশ সরবরাহ করে। ব্রাজিল ছাড়াও, Vietnam কফি উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কলাম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ইথিওপিয়া। ব্রাজিল- উৎপাদন ও সরবরাহের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। ভিয়েতনাম- বিশ্বের কফি উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক। কলম্বিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার একটি প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশ। ইন্দোনেশীয়-এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কফি উৎপাদনকারী।

ইথিওপিয়া : আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং কফির জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উৎপাদক দেশ-কফি উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পেরু- জৈব ও ফেয়ার ট্রেড কফির জন্য পরিচিত। মেক্সিকো- ভালো মানের কফি উৎপাদনের জন্য পরিচিত।

গুয়াতেমালা- উচ্চমানের অ্যারাবিকা কফির জন্য বিশেষ পরিচিত। কফি উৎপাদন সম্পর্কিত বাস্তব তথ্য হলো- বিশ্বের ৪১% কফি দক্ষিণ আমেরিকায়, ২৭% দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ১৭% আফ্রিকায় এবং ১০% মধ্য আমেরিকায় উৎপাদিত হয়। কফি উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশ : কফি চাষের জন্য ২৩-২৮ °C (৭৩-৮২ °F) তাপমাত্রা সবচেয়ে অনুকূল।

বাংলাদেশেও কফি চাষ হয়। পাহাড়ি জেলা যেমন- বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং সমতল ভূমির জেলা টাঙ্গাইল, রংপুর, নীলফামারীতে কফি চাষ প্রচলিত। ‘বাংলাদেশে বারি কফি-১’ ও ‘বারি কফি-২’ (এরাবিকা ও রোবেস্টা জাতের) মতো উপযুক্ত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে এবং কৃষকরা কফি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, যা দেশের কৃষি অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করছে।

কফি চাষের উল্লেখযোগ্য এলাকা হলো : পাহাড়ি অঞ্চল- বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি। সমতল ভূমি- টাঙ্গাইল, রংপুর, নীলফামারী। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলে কফি চাষ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো কফি চাষের জন্য উপযুক্ত জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদে সহায়তা করছে। বাংলাদেশে কফি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়নি, তবে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা এটিকে উৎসাহিত করার জন্য কাজ করছে।

কফি উৎপাদন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হয়, যেমন কফি পশুর বিষ্ঠা থেকে তৈরি, অথবা এটি ক্ষতিকর- তবে এগুলো সাধারণত তথ্যভিত্তিক নয়। আসল তথ্য হলো, কফি একটি ফল গাছ থেকে তৈরি হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়। কফি উৎপাদন একটি জটিল প্রক্রিয়া যার জন্য নির্দিষ্ট জলবায়ু ও পরিবেশ প্রয়োজন।

গল্প আড্ডায় কফি পান করা মানুষকে উষ্ণতা, সতেজতা ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে, যা আলোচনাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। কফির ক্যাফেইন মস্তিষ্কের সতর্কতা বাড়ায় এবং ক্লান্তিবোধ কমায়, যা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনায় মগ্ন থাকতে সহায়ক। এছাড়াও, কফি পানের সামাজিক দিক এবং আরামদায়ক পরিবেশ গল্পের আসরকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।

‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ বিখ্যাত বাংলা গান, যা কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে গেয়েছেন। গানটি হারানো বন্ধুত্বের স্মৃতি, ফেলে আসা সময়ের প্রতি এক স্মৃতিকাতর অনুভূতি এবং সময়ের বিবর্তনে মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের এক জীবন্ত বর্ণনা। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই গানটি রচনা করেন, যেখানে তিনি মূলত কলকাতার এক সময়ের বিখ্যাত কফি হাউসের আড্ডার স্মৃতিচারণ করেছেন এবং সেই আড্ডায় থাকা বিভিন্ন বন্ধু ও তাদের জীবনযাত্রার কথা তুলে ধরেছেন। গানটিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে আসা পরিবর্তন, বিচ্ছেদ এবং জীবনের উত্থান-পতনকে এক করুণ সুরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গানটি একটি বিশেষ কফি হাউসের আড্ডা, সোনালী বিকেল, এবং বন্ধুদের হারিয়ে যাওয়ার এক বিষণ্ণ স্মৃতিচারণ করে।

এটি ক্যাফেইন সমৃদ্ধ এবং শরীর ও মনকে চাঙ্গা করতে, মনোযোগ বাড়াতে এবং ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। কফিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকে, যা হৃদরোগ প্রতিরোধ ও লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে। তবে, পরিমিত পরিমাণে পান করা উচিত; অতিরিক্ত কফি খেলে অনিদ্রা, বদহজম ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এটি শুধু একটি পানীয় নয়, বরং ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ একটি পুষ্টি উৎস, যা কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এবং হজম শক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। স্বাস্থ্যকর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফিন গ্রহণ নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়, যা প্রায় দুই থেকে তিনটি কফি কাপের সমান। অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কফি লিভারের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে যাদের হৃদরোগ, অনিদ্রা বা গর্ভবতী তাদের কফি পান করা উচিত নয়।

সঠিক পরিমাণে চিনি ছাড়া কফি পানে শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, মনোযোগ বাড়ে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং লিভারের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস-২ এর ঝুঁকি কমায় এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। পরিমিত পরিমাণে কফি লিভারের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং কিছু লিভার রোগের ঝুঁকি কমায়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পরিমিত কফি পানে হৃদরোগ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিন কাপ কফি পানে আয়ু বাড়তে পারে।

এ পর্যায়ে কফি পান করা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি রোমন্থন করছি। আমার এক বন্ধু ছিল নাম তার রাহুল। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর এক কফির কাপের মতোই। আমি অপহরণকারীদের (মাদক চোরাকারবারি) থেকে মুক্ত হওয়ার পর দিল্লির যে আবাসিকে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলাম। সেখানে বন্ধু রাহুল প্রতিদিন আমাকে দীর্ঘ সময় সঙ্গ দিত। যেখানে আমরা একান্তে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কত কথা বলতাম। সেই ক্যাফেটার প্রতিটি কোণায় আজও যেন রাহুল বসে আছে। তার হাসি, কথাগুলো এখনও কানে বাজে। পুরোনো সেই দিনগুলোর মতো আজও মনে পড়ে, একসাথে কফি পান করতে করতে জীবনের সব গল্প ভাগ করে নিতাম। যখন আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেল, আমি বাংলাদেশে চলে আসলাম, তখন বুঝিনি জীবনের এত শূন্যতা হবে। রাহুলের উপস্থিতি ছিল আমার জীবনের এক আশীর্বাদের প্রতীক। আজও যখন কফি খেতে বসি, মনে হয় যেন তুমি পাশে বসে আছ, একই কাপে কফি নিয়ে। রাহুল তুমি কিছুদিন পূর্বে না ফেরার দেশে ফাডি জমিয়েছ। সেই দিনগুলো ছিল অসাধারণ ও আনন্দময়। তোমার সঙ্গে কাটানো সেই মুহূর্তগুলো আজও অমলিন, যা আমার মনে সবসময় রয়ে যাবে। তোমার স্মৃতিগুলো আমার কাছে অমূল্য। ওপারেও ভালো থেকো রাহুল। কফিকে সঙ্গী হিসেবে পেতে, এটিকে একটি ভালোবাসার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করুন, কারণ এটি যত্ন, সংযোগ এবং সান্ত¡না প্রকাশ করার একটি মাধ্যম। কফি তৈরি করা, প্রিয়জনের জন্য একটি ল্যাটে প্রস্তুত করা, অথবা কফিহাউসে একসঙ্গে সময় কাটানো- এই সবই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে। বাংলাদেশে কপি চাষে ভালো ফলন পেতে উন্নত জাত নির্বাচন, সঠিক সময়ে বীজ বপন ও চারা রোপণ, যথাযথ সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং রোগ ও পোকা দমনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া, সুকৃষি অনুশীলন অনুসরণ করা, পরিবেশবান্ধব উপায়ে কৃষি উপকরণ ব্যবহার করা এবং ভালো ফলন নিশ্চিত করতে সঠিক বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল