উচ্চশিক্ষার খোলনলচে বদলে ফেলা দরকার

ড. একেএম মতিনুর রহমান

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিবর্তন যেমন দ্রুত ঘটছে, তেমনই এর সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উচ্চশিক্ষাকে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। সমস্যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে যেমন তাদের শিক্ষার মান ও প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করার জন্য ক্রমবর্ধমান চাপে পড়ছে, তেমনই অন্যদিকে এমন এক নীতি-কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যা প্রতিমুহূর্তে তাদের স্বাধীনতা, কার্যকারিতা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাকে খর্ব করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিভিন্ন সময়ে নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিচালন এবং মান নিশ্চিতকরণ (QA) সংস্কার বাস্তবায়িত হয়ে এসেছে এবং এখনও অব্যাহতভাবে তা চলমান আছে। প্রশ্ন হলো, প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতার সঙ্গে এসব সংস্কার কার্যক্রমের কার্যকারিতা, স্থায়িত্ব ও সামঞ্জস্য নিয়ে উদ্বেগ দূর হয়েছে কি?

এ লেখাটির উদ্দেশ্য নীতিকাঠামোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন এবং QA -এর মধ্যকার সম্পর্ককে পরীক্ষা করা। বিশেষ করে স্বল্পপরিসরে এটা আলোচনা করা যে, পরিচালন কাঠামো কীভাবে QA সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা, স্বায়ত্তশাসন ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা জোরদার করতে উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের গৃহীত নীতিগুলোকে কীভাবে অধিকতর উন্নত করা যায়, তা ভেবে দেখার আহ্বান জানানো, যাতে একাডেমিয়াতে এ নিয়ে কার্যকর আলোচনা হতে পারে।

অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর একটি দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয় এবং ২০০৮ সালে নেওয়া হয় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নমূলক প্রকল্প (HEQEP)। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি)। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি), যা ইউজিসির অধীনে কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ইউনিট হিসাবে শুরু হয়েছিল। বিএসির অধীনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক (বিএনকিউএফ) প্রণীত হয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণের পরও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালন, সুশাসন এবং মান নিশ্চিতকরণ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত বলে একাডেমিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সময় সময় উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়। এর কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনব্যবস্থাকে কঠিনভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে।

বিগত ১৫ বছরে বলতে গেলে এটাকে একধরনের ধসিয়েই দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে একটি বড় পরিবর্তন সূচিত হওয়ার পরও এখনো দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, পশ্চাৎমুখী যে প্রবণতা অব্যাহত ছিল, সেটির সংস্কারের বিষয়ে একাডেমিক তোড়জোড় দৃশ্যমানভাবে কম। কিছু পরিবর্তন ব্যক্তিপর্যায়ে নেওয়ার মানে এই নয় যে, ব্যবস্থা বদলে গেছে এবং ধারাবাহিকভাবে তা ভালোর দিকে ধাবিত। মজার বিষয় হলো, এ নিয়ে কারও তেমন উচ্চবাচ্য নেই।

এখনো উচ্চপর্যায়ে রয়েছে খুবই কেন্দ্রীভূত একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা, যা রাজনৈতিক রেজিম চেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন চেহারা নিয়ে নেবে, তা অনুমান করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি তোলা দরকার তা হলো, উদ্ভাবনকে গ্রহণ করতে বর্তমানের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু মনোযোগী? উদ্ভাবনের নীতিকাঠামোগুলো কি কার্যকরভাবে ফল দিচ্ছে? আমরা কি কার্যকরভাবে কোনো শিক্ষায়তনিক বিতর্ক করছি এসব নিয়ে? তার ফল কী? আমাদের মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক পর্যায়ে, সত্যি কথা বলতে কী, উদ্ভাবন ও জীবনব্যাপী শিক্ষাকে আজকাল টিকে থাকার মানদ- হিসাবে দেখা হচ্ছে। আমরা কি আমাদের পাঠ্যক্রমগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিমার্জন করছি? আমাদের কর্মকাঠামোগুলো কি অংশিজনদের ভাবনাচিন্তাকে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত করছে?

শিক্ষার মানের দিকটি যদি দেখা হয়, তাহলে যে প্রশ্নটি সামনে আসবে তা হলো, বর্তমনের ছঅ প্রচেষ্টা কি ঠিকভাবে কাজ করছে? এর মূল কলকাঠিটি দাতাদের হাত থেকে কি আমাদের হাতে আনা গেছে? একাডেমিক ট্রান্সফরমেশন ফান্ড কি সঠিকভাবে প্রকল্প বাছাই করছে, যা আমাদের দেশজ ও বৈশ্বিক উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হাসিল করার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? বেসরকারীকরণ ও শিক্ষার এলিটায়ন কি শেষকথা? আমাদের মতো একটি দেশে এমন ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত হতে পারে কি?

যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে হলে ও টিকে থাকতে হলে আমাদের উচ্চশিক্ষায় আমূল সংস্কার আনতে হবে। বিদ্যমান নীতিগুলো জবাবদিহিহীন এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, আমাদের স্বায়ত্তশাসন ও উদ্ভাবনের মধ্যে পর্যাপ্ত ভারসাম্য বজায় রাখা যাচ্ছে না। সুশাসন এবং QA কে প্রায়ই আলাদা করে দেখা হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংগতিপূর্ণ অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর ফলে নীতি ও অনুশীলনের মধ্যে যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, তা অলঙ্ঘনীয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে যেমন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, অন্যদিকে তেমনি বৈশ্বিক প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষকদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়কর ক্ষতি হচ্ছে। ফলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সমাজের চাহিদাও পূরণ করতে পারছে না, বৈশ্বিক মর্যাদাক্রমেও স্থান পাচ্ছেন না। ফলস্বরূপ, পরিচালন এবং QA নীতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া অন্বেষণ করা এ মুহূর্তে এক অত্যাবশ্যকীয় কাজ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। কোথায় দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে, কোথায় অসংগতি আছে, অনতিবিলম্বে তা চিহ্নিত করা যেমন জরুরি, স্থায়ী সংস্কারের জন্য অধিকতর সমন্বিত কাঠামো তৈরি করাও তেমনই অপরিহার্য। যেহেতু বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘ দুঃশাসন অপসারিত হয়েছে, উচ্চশিক্ষার খোলনলচেটা আমূল বদলে ফেলাও এখন তাই সময়ের দাবি। দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা সংস্কারের জন্য এখনো কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। যদিও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারে একাধিক কমিশন গঠিত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা খাতে এমন কোনো কমিশন না হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে এবং শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। অতএব, অবিলম্বে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিশন গঠন করা যায়। এ কমিশন ১. গভীর মনোযোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালন এবং QA নীতিকাঠামোকে পরীক্ষা করবে; ২. পরিচালন কাঠামো কীভাবে QA প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে, তা তদন্ত করবে; ৩. প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন, জবাবদিহিতা এবং বাহ্যিক মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কোথায় টেনশন তৈরি হচ্ছে, কী কারণে হচ্ছে সেটি অনুসন্ধান করবে; ৪. স্থানীয় সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি কীভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্জন করতে পারে, তা খতিয়ে দেখে সুপারিশ প্রণয়ন করবে; ৫. পরিচালন ও QA -এর মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিবিধানের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করবে। একাডেমিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনতিবিলম্বে এই মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে যে, ১. বাংলাদেশে এবং তুলনামূলক প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরিচালন এবং QA নীতিগুলো কীভাবে বিকশিত হয়েছে, বা হচ্ছে? ২. পরিচালন কাঠামো কীভাবে ছঅ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ও ফলাফলকে প্রভাবিত করে? ৩. উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন, জবাবদিহিতা এবং বাহ্যিক মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কী কী টানাপড়েন বিদ্যমান? ৪. স্থানিক অংশগ্রহণ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জন্য পরিচালনব্যবস্থা এবং QA -কে আরও ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য নীতি কাঠামোকে কীভাবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে?

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়