মেয়েদের কণ্ঠকে শৃঙ্খল নয়, শক্তি বানাতে হবে
মোছা. সাইফুন নাহার সায়লা
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দক্ষিণ এশিয়ান সমাজ, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নানা সংস্কৃতিতে কন্যা সন্তানদের ছোটবেলা থেকে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে গড়ে তোলার প্রচলন এখনও বহুলভাবে বিদ্যমান। জন্মের পর থেকেই একটি অদৃশ্য সামাজিক শৃঙ্খল তাদের চারপাশে তৈরি করা হয়, যা তাদের আচরণ, চলাফেরা, কথা বলা এমনকি স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বাবা-মা, পরিবার কিংবা সমাজ অনেক সময় মনে করে মেয়েদের শান্ত, নীরব, ভদ্র এবং সংযত হয়ে বড় হতে হবে। তাদের বলা হয়- ‘চুপ করো’, ‘এত জোরে কথা বলো না’, ‘মেয়েদের বেশি কথা বলা ভালো না’, ‘শান্ত মেয়েকেই সবাই পছন্দ করে’। এসব কথাই ধীরে ধীরে মনের গভীরে প্রোথিত হয় এবং একটি শিশু তার স্বাভাবিক কৌতূহল, প্রাণবন্ততা ও মত প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলে।
একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসই তাকে শেখায় নতুন কিছু জানার আগ্রহ, ভুল করলে আবার চেষ্টা করার মানসিকতা, নিজের মতো প্রকাশের সক্ষমতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি। কিন্তু যখন ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের বলা হয় কথা কম বলতে, প্রশ্ন না করতে, নিজের মতো প্রকাশ না করতে- তখন তারা ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে যায়। সমাজ তখন তাদের শেখায়, নীরব থাকাই নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য, নীরব থাকলেই নাকি তারা সুশীল বা আদর্শ কন্যা হবে। অথচ নীরবতা কখনোই নারীর সৌন্দর্য নয়; বরং নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহসই নারীর আসল মর্যাদা।
দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাজনীতি কিংবা পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাদের মতামতকে তুচ্ছ জ্ঞান করার প্রবণতা সমাজে আজও প্রবল। অথচ ইতিহাস বলছে, নারীরা যখন নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করেছে, তখনই সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সারওয়ার জাহান কিংবা ইন্দিরা গান্ধী- এরা সবাই ছোটবেলার শৃঙ্খল ভেঙে নিজের মতামত প্রকাশের সাহস দেখিয়েছিলেন, বলেই তারা পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
মেয়েদের নীরব করে রাখা মানে তাদের সম্ভাবনাকে অচল করে রাখা। একজন ছেলে শিশু যখন প্রশ্ন করে, প্রতিবাদ করে বা নিজের মতামত প্রকাশ করে, তখন তাকে ‘স্মার্ট’ বলা হয়। অথচ একই কাজ যদি একটি মেয়ে করে, তখনই তাকে ‘অতিরিক্ত কথা বলা’, ‘বেয়াদব’ কিংবা ‘অভদ্র’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই দ্বৈত মানসিকতাই আসলে নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো উচিত যে তাদের কণ্ঠস্বরও সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাদের ভাবনাও মূল্যবান, তাদের প্রশ্ন করার অধিকারও অপরিসীম।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুলে মেয়েদের মতামত প্রকাশে উৎসাহিত করা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বা নেতৃত্বমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো- এসবই তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। পরিবার যদি মেয়েদের স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা বলার সুযোগ দেয়, তাহলে তারা বড় হয়ে সমাজে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পারে। একজন মেয়ে যখন পরিবারে কোনো বিষয়ে নিজের মতামত দিতে শিখবে, তখন সে কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিতে কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মতামত প্রকাশ করতে পারবে।
নারীর ক্ষমতায়নের মূল দর্শনই হলো- নারী যেন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, নিজের কথা বলতে পারে, নিজের জীবন নিজের মতো করে গড়তে পারে। ক্ষমতায়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং মানসিক ও সামাজিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরি করা।
এজন্য দরকার ছোটবেলা থেকেই তাদের শেখানো- নিজেকে মূল্য দেওয়া, নিজের কণ্ঠকে শ্রদ্ধা করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা না হওয়া।
একটি পরিবারে যদি মেয়ে সন্তানকে বলা হয়- ‘তুমি চুপ থেকো, বেশি প্রশ্ন কোরো না’- তাহলে সে একসময় নিজের ভেতরের সব কৌতূহল মুছে ফেলবে। অন্যদিকে যদি তাকে শেখানো হয়- ‘তোমার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, তুমি নিজের মতো করে ভাবতে পারো’ তাহলে সে বড় হয়ে একজন আত্মবিশ্বাসী নারী হিসেবে গড়ে উঠবে, যে সমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পরিবারে আজও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে মেয়েদের নীরব থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। তারা যেন পরিবারের সিদ্ধান্তে মুখ খোলে না, সমাজের অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ না করে, এমনকি নিজের জীবনের সিদ্ধান্তও অন্যদের ওপর ছেড়ে দেয়। অথচ একটি সভ্য সমাজের জন্য জরুরি হলো নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ। যদি অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নীরব করে রাখা হয়, তাহলে সেই সমাজ কখনওই পূর্ণ বিকাশে পৌঁছাতে পারবে না। নারীর ক্ষমতায়ন আসলে শুধু নারী নয়, গোটা সমাজের উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন আত্মবিশ্বাসী নারী যখন বড় হয়, তখন সে পরিবারে তার সন্তানদেরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তার শিক্ষা, তার চিন্তাধারা, তার সাহস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং মেয়েদের নীরব করে রাখা মানে শুধু একজন মানুষকে নয়, গোটা সমাজকে পিছিয়ে দেওয়া।
আজকের পৃথিবী সমান সুযোগের কথা বলে, টেকসই উন্নয়নের কথা বলে, জেন্ডার ইক্যুইটির কথা বলে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) পঞ্চম লক্ষ্যই হলো জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশও সে লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনও গ্রাম থেকে শহর- সব জায়গায় মেয়েদের চুপ থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি।
আমরা যদি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন চাই, তবে প্রথম পদক্ষেপ হবে মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো- তুমি নীরব থাকার জন্য জন্মাওনি, তুমি তোমার কথা বলার জন্য জন্মেছো। তোমার কণ্ঠস্বরও পৃথিবী বদলাতে পারে। সমাজকে বুঝতে হবে, মেয়ে মানে কেবল দায়িত্বশীল বা আজ্ঞাবহ মানুষ নয়, বরং একজন স্বতন্ত্র সত্তা, যার নিজের মতামত, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত নারীর ক্ষমতায়ন মানে হলো- একজন নারী যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, নিজের অধিকার দাবি করে এবং নিজের কণ্ঠকে শ্রদ্ধা করে, তখনই সে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হয়। তাই মেয়েদের নীরবতা শেখানো নয়, বরং তাদের নিজের মতো প্রকাশের সাহস শেখানোই হবে আগামী দিনের সমাজকে আলোকিত করার প্রথম শর্ত।
লেখক : এনজিও কর্মী, বগুড়া সদর থানা, বগুড়া
