গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও শিল্পের অদৃশ্য সংকট

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতির অগ্রণী খাত। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি নয়, দেশের লাখ লাখ নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়। তবে এই শিল্পখাতে কাজ করা নারী শ্রমিকদের জীবন নিরাপদ নয়। ঘর এবং কর্মক্ষেত্র- উভয় জায়গাতেই তারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এই দিকটি প্রায়শই অদৃশ্য থাকে, অথচ এটি তাদের জীবনমান ও উৎপাদনশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি ঢাকার মহাখালী ক্যাম্পাসে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় পরিচালিত কোহর্ট গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই বছরে কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের মানসিক সহিংসতার হার ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে। এই ঊর্ধ্বগতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, শ্রমিকদের মানসিক নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলা ক্রমেই বাড়ছে।

উদ্বেগজনক হলো, সহিংসতার শিকার নারীরা সাধারণত সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন। গবেষণার শুরুতে ৩৫ শতাংশ নারী পরিবার বা বন্ধুদের কাছে সহায়তা চাইতেন, কিন্তু দুই বছর পরে এটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১ শতাংশে। এটি নির্দেশ করে যে, সহিংসতার শিকার নারীরা নিরাপত্তাহীনতা, লজ্জা বা সামাজিক চাপের কারণে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে সাহায্য নিতে সাহস পান না।

কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনায় কর্তৃপক্ষকে জানানোও সীমিত। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজনই কর্তৃপক্ষকে সহিংসতার অভিযোগ জানান, এবং দুই বছর পরও এই চিত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, শুধু আইন বা নীতিমালা থাকা যথেষ্ট নয়; বাস্তবায়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিই মূল চাবিকাঠি। শুধু মানসিক ও শারীরিক সহিংসতা নয়, নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাও উদ্বেগজনক। জরিপে দেখা গেছে, কর্মরত নারীরা যেখানে কাজ করছেন, শুধুমাত্র ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় এবং মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহের তথ্য আছে। স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগ সীমিত থাকায় নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যা তাদের উৎপাদনশীলতা ও জীবনমানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

এছাড়া, গবেষণায় দেখা গেছে যে, নারী শ্রমিকরা প্রায়ই ঘরেও সহিংসতার শিকার হন। গত এক বছরে স্বামী বা পরিবারের পক্ষ থেকে সহিংসতার হার অনেক বেশি। ঘরে সহিংসতার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক চাপ তাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করছে। একদিকে পরিবার ও সমাজের চাপ, অন্যদিকে কাজের পরিবেশের চাপ- এটি নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। মানসিক সহিংসতা যেমন উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও হতাশার সৃষ্টি করে, তেমনি এটি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, রাষ্ট্র এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শ্রম আইন এবং শ্রমিক কল্যাণ সংক্রান্ত বিধান থাকা সত্ত্বেও কার্যকর নজরদারি না থাকা, অভিযোগ দমন এবং সহায়তার সীমাবদ্ধতা নারী শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। এটি একটি চরম দুর্বলতা এবং তা শিল্পখাতের স্থায়িত্ব ও মানকে প্রভাবিত করছে। নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধুমাত্র নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি অর্থনীতির স্থায়িত্বের জন্যও অপরিহার্য। যখন নারী শ্রমিকরা মানসিক ও শারীরিকভাবে নিরাপদ থাকেন, তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে নিরাপত্তাহীন ও স্বাস্থ্যহীন অবস্থায় কাজ করলে তা শিল্পখাতের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব শুধুই উৎপাদন নয়; তাদের অবশ্যই শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাবনা জরুরি। প্রথমত, প্রতিটি কারখানায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে নারী শ্রমিকরা নিরাপদভাবে সহিংসতার ঘটনা জানাতে পারে। দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সহিংসতা মোকাবিলায় কাউন্সেলিং সেবা, শ্রমিক কল্যাণ অফিস, অভ্যন্তরীণ কমিটি স্থাপন করা উচিত। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করতে হবে- স্যানিটারি প্যাড, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী এবং প্রজনন স্বাস্থ্য পরামর্শ সহজলভ্য করতে হবে। চতুর্থত, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে নারীরা ঘরেও সহিংসতার শিকার না হন এবং সহায়তা চাইতে সাহস পান।

সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ পদক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারকে শ্রম আইন শক্তিশালী করতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। শ্রমিক অধিকার রক্ষার জন্য নিয়মিত মনিটরিং ও অডিট জরুরি। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও দায়িত্ব নিতে হবে। তারা যেন নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করতে পারে যে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা পাচ্ছে। নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে কেবল জীবনমান রক্ষা নয়, এটি দেশের অর্থনীতিকে স্থায়ী ও সুস্থ রাখতেও সহায়ক। গার্মেন্ট শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘হৃদয়’, কিন্তু সেই হৃদয়কে সুস্থ রাখতে হলে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা মানে সমগ্র খাতের এবং দেশের ভবিষ্যত ঝুঁকিতে ফেলা।

সর্বশেষে বলা যায়, নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা না করা শুধু মানবিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিপজ্জনক। সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ- তিন পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। নারী শ্রমিকদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, অভিযোগ জানানোর নিরাপত্তা দিতে হবে এবং মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। এখনই সময় এই সংকট মোকাবিলার, নয়তো আমরা শিল্পখাতের মূল চালিকাশক্তিকে হারাতে বসব।

লেখক : আমদির পাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা