দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে প্রকৃত রহস্য

মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় একের পর এক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে করে তুলছে দূর্বিষহ। চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, রসূন, আদা, চিনি, মসলা থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল পর্যন্ত সব রকম পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাইকারি থেকে খুচরা সব জায়গায় দাম নিয়ন্ত্রণহীন। বাজার এখন সিন্ডিকেটের কবজায়, সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের একাংশ মনে করেন, একটি সিন্ডিকেট চক্র দীর্ঘদিন ধরে বাজারে কৃত্রিমসংকট তৈরি করে ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়াচ্ছে। ভোক্তাদের অভিযোগ সিন্ডিকেটের শক্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছে। চালসহ নিত্যপণ্যের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলা যায়। খাদ্যশস্যের দাম আকাশচুম্বী। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে মাছ-মাংসের বাজার।

চাল নিয়ে চালবাজি থেমে নেই। ভরা মৌসুম ও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম নিম্নমুখী হলে ও আমাদের দেশের চালের বাজার অস্থিতিশীল। সিন্ডিকেট নামক অদৃশ্য শক্তির দাপটে চালের বাজার চলছে। চাল খাতকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বড় উদাহারন মনে করে সাধারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, ধান সংগ্রহ থেকে শুরু করে চাল মজুত ও বাজারজাত করার পুরো প্রক্রিয়া একশ্রেণির মিল মালিক ও আড়তদারদের হাতে কেন্দ্রীভূত। তারা একযুগে চাল গোডাউন ও আড়তে মজুত করে বাজারে কৃত্রিমসংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করেন। একইভাবে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, মসলার মতো আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে ও সিন্ডিকেট সক্রিয়।

সীমান্ত বাণিজ্যের উপর নির্ভরতা এবং বিকল্প উৎসের অভাবে অল্প কয়েকজন প্রভাবশালী আমদানিকারক সহজেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে চিনি ও ভোজ্যতেল খাত সরাসরি হাতেগোনা কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর দখলে। দেশের মোট চাহিদার বড় অংশ তারা আমদানি ও উৎপাদন করে থাকে।

ফলে সরবরাহে সামান্য পরিবর্তন ঘটালেই বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। ডাল, আটা, ময়দা ও মসলার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বড় আমদানিকারক ও পাইকাররা যোগসাজশ করে বাজার দখল করে রাখছে। গোডাউনে ভোজ্যতেলের পর্যাপ্ত মজুত সত্ত্বেও তারা আমদানি ও সরবরাহের স্বল্পতা দেখিয়ে খুচরা বাজারে দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করেন। বড় বড় শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা বাজারে দাম নির্ধারণ করে দেয়, খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের নির্দেশ অনুযায়ী পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন।

এই নিয়মটা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। আরেকটি অভিনব নতুন কৌশল হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিমসংকট সৃষ্টি করে বাজারে দাম বৃদ্ধি করার জন্য লাইটার জাহাজকে ভাসমান গুদাম বানিয়ে ভোগপণ্য মজুতকরণ প্রক্রিয়া। বিশেষ করে চাহিদাকে পুঁজি করে রমজানের আগে ব্যবসায়ীরা এই অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আমদানিকারকরা নিজস্ব গুদাম কিংবা ভাড়ায় চালিত বিভিন্ন গুদামে পণ্য মজুত করেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লাইটার জাহাজকে ভাসমান গুদাম বানিয়ে পণ্য মজুত প্রথা চালু হয়। ভাড়ার গুদামে দিনের পর দিন পন্য মজুত করে রাখার যে খরচ হয় সে হিসাবে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুত করলে খরচ কম পড়ে। তাছাড়া খালাসের পর গুদামে পণ্য মজুত করলে তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির হাতে থাকে। এতে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আছে কি না তা জানা যায় এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। পক্ষান্তরে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুত করলে তার হিসাব খুব সহজে বের করা যায় না এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করা যায়।

গত ০৩-১০-২০২৫ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় পণ্য মজুতের এই ভয়ংকর খবরটি প্রকাশিত হয়। ব্যবসায়ীরা এই কৌশলটি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীতে অভিযান চালিয়ে ৭ হাজার টন গম নিয়ে ১ মাস ধরে বসে থাকা ৬টা লাইটার জাহাজকে জরিমানা করা হয়েছে। ফলে পণ্য মজুদারি ও কারসাজি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের বাঁধার কারণে নিত্যপণ্যের বাজার দর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামছে না। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজির কারণে পণ্য মূল্যের দাম বাড়ছে। আগে যেখানে ১ টাকা চাঁদা নেওয়া হতো এখন সেখানে ২ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

৫ আগস্টের পর নানা পক্ষ চাঁদাবাজিতে ভাগ বসিয়েছে। আগে যারা চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিল তারা ও পুনরায় চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। যারা চাঁদাবাজি করে তারাই আবার ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্য। পথে পথে পুলিশ, নেতাকর্মী ও শ্রমিক সংগঠনচক্র তিন টনি ট্রাকে গড়ে ৪ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে। চাঁদাবাজিতে সবজির দাম বাজারে চারগুণ চড়া। চাঁদাবাজির কারণে কৃষক পর্যায়ের ২০ টাকার বেগুন ঢাকা চট্টগ্রাম শহরে ৭০ টাকা দিয়ে ভোক্তাকে ক্রয় করতে হয়। কৃষক সবজি বিক্রি করার পর ভোক্তার ব্যাগে উঠার আগে ব্যাপারি, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ চার থেকে পাঁচ স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীরা কয়েক দফা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে করে মাঠে ঠকছেন কৃষক এবং আর বাজারে ভোক্তা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহা শহরে চড়া দামে শাকসবজি বিক্রি হলেও কৃষকরা; কিন্তু সেই ন্যায্য দাম পায় না। মূলত চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে সবজির দাম চড়া। ভ্যালু চেইন, বাজার পর্যায়ে সঠিক মনিটরিং না থাকা, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য, উৎপাদন ও সরবরাহে সমন্বয় না থাকায় বাজারে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির আরেকটা প্রধান কারণ হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। উত্তর বঙ্গ থেকে এক ট্রাক সবজি নিয়ে খাতুনগঞ্জ আড়তে আসলে ৩২-৩৫ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া প্রদান করতে হয়। যেটি আগে পরিশোধ করতে হতো ১২ হাজার টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই চাঁদা তোলার শুধু হাতবদল হয়েছে।

জায়গায় জায়গায় চাঁদাবাজরা দিব্যি কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাইকারি আড়তে অবৈধ কমিশন বানিজ্য আগের মতো পুরোদমে এগিয়ে চলছে। অবৈধ সিন্ডিকেট তৈরি করা ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা আগের মতো কারসাজিতে লিপ্ত রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান গরম হলে ও জনগণের জীবন টিকে রাখার বাজার নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। পরিশেষে, পণ্যদ্রব্যের মূল্য কমাতে হলে সরকারকে সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ, পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য বন্ধ, অবৈধ মজুতদারি বন্ধ, জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণ, কর শুল্ক হ্রাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট