দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সমীরণ বিশ্বাস

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বায়ুদূষণ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ইটভাটা, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস, ধূলিকণা, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সূক্ষ্ম কণা (PM2.5 ও PM10) বেড়ে যাচ্ছে।

এসব দূষণকারী পদার্থ দীর্ঘমেয়াদে মানুষের শ্বাসযন্ত্র, হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ু দূষণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বর্তমানে বায়ুদূষণের ভয়াবহ মাত্রায় ভুগছে। বায়ু দূষণের মাত্রা বোঝার জন্য এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদ-। এটি বাতাসে বিদ্যমান দূষণকারীর ঘনত্বের ভিত্তিতে বায়ুর মান নির্ধারণ করে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স যত বেশি, স্বাস্থ্যঝুঁকিও তত বেশি। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য এই ঝুঁকি মারাত্মক। তাই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বায়ুর মান উন্নয়ন মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।

IQAir হচ্ছে- সুইসভিত্তিক একটি কোম্পানি, যারা বায়ুর গুণমান মনিটরিং, বায়ু বিশুদ্ধকরণ এবং দূষণ সম্পর্কিত তথ্য সংক্রান্ত কাজ করে। ‘IQAir’ নামটি ‘IQ’ + ‘Air’ মিলিয়ে গঠিত, যেখানে ‘IQ’ ইংরেজিতে ‘Intelligence Quotient’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও, এই ক্ষেত্রে এটা ‘INTELLIGENT QUALITY AIR’ বা ‘আইকিউ এর (বুদ্ধিমান) বাতাস’ বোঝায়।

বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়ে উদ্যোগ জরুরি। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৃক্ষরোপণ, শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বায়ুদূষণ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।

অর্থাৎ এমন একটি পরিষ্কার, নিয়ন্ত্রিত বাতাস যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ওছ সাধারণভাবে বোঝায় ‘বুদ্ধিমত্তা’ বা ‘মেধা’, যা এখানে বায়ুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারকে বোঝায়। অর্থাৎ বায়ু ও বায়ুর গুণমান। এই স্কোর আসলে Air Quality Index (AQI) নামে পরিচিত, যা বায়ুর মান বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্দেশ করে।

অছও স্কোরের স্তর ও স্বাস্থ্য প্রভাব : AQI স্কোর ০-৫০, মানের স্তর ভালো (Good), স্বাস্থ্য প্রভাব- কোনো ঝুঁকি নেই, বাইরে সময় কাটানো নিরাপদ। AQI স্কোর ৫১-১০০, মানের স্তর- মাঝারি, স্বাস্থ্য প্রভাব- সংবেদনশীলদের জন্য হালকা প্রভাব। AQI স্কোর ১০১-১৫০, মানের স্তর- সংবেদনশীলদের জন্য অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্য প্রভাব- শিশু, প্রবীণ, অসুস্থদের জন্য সতর্কতা দরকার। AQI স্কোর ১৫১-২০০, মানের স্তর- অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্য প্রভাব- সাধারণ জনগণের জন্যও স্বাস্থ্যঝুঁকি। AQI স্কোর ২০১-৩০০, মানের স্তর- খুব অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্য প্রভাব- গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাইরে যাওয়া সীমিত করা উচিত। AQI স্কোর ৩০১-৫০০ বিপজ্জনক।

বিশ্বের শীর্ষ ৫ দূষিত শহর (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) : বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় একনম্বরে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর। লাহোরের স্কোর ১৮৮। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার স্কোর ছিল ১৭২। তৃতীয় অবস্থানে ভারতের কলকাতা, স্কোর ১৬৭। চতুর্থ স্থানে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসার, স্কোর ১৫৮। পঞ্চম স্থানে থাকা ভিয়েতনামের হ্যানয়, স্কোর ১৫৭।

বায়ুদূষণ ও মানবস্বাস্থ্য, একটি বৈশ্বিক সংকট : বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হলো শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের নির্গমন, কয়লা ও জ্বালানি তেল পোড়ানো, কৃষি কার্যক্রমে রাসায়নিক ব্যবহার এবং বনভূমি ধ্বংস। সূক্ষ্ম ধূলিকণা (PM2.5 ও PM10), সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং ওজনের মতো দূষিত উপাদান সরাসরি মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে নানা জটিল রোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক অসুখে মানুষ ভুগছে।

বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণ শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না বরং মানসিক চাপ, মনোযোগের ঘাটতি এবং শিশুদের মেধাগত বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা আরও প্রকট, কারণ সেখানে নগরায়ণ দ্রুত বাড়লেও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা তেমন কার্যকর নয়। এই বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়ে উদ্যোগ জরুরি। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহার, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৃক্ষরোপণ, শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বায়ুদূষণ অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও অপরিহার্য, কারণ বায়ু সীমান্ত মানে না, এক দেশের দূষণ অন্য দেশকেও প্রভাবিত করে। অতএব, ৭০ লাখ মৃত্যুর এই করুণ বাস্তবতাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। মানবস্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি : বায়ুদূষণের কারণে স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ফুসফুসের ক্যান্সার এবং বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যায়।

কেন এই ভয়াবহ রোগগুলো হয়? প্রথমত, বায়ুদূষণের সূক্ষ্ম কণিকা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5 ও PM10) রক্তে প্রবেশ করে ধমনীর ক্ষতি করে, যা উচ্চ রক্তচাপ ও ধমনী সংকোচনের ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলস্বরূপ স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

বায়ু দূষণ যেকোনো দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষম মানুষের অসুস্থতা ও অকাল মৃত্যু শ্রমশক্তি কমিয়ে দেয় এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কারণে ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয়। এর ফলে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা COPD দেখা দেয়, যা শ্বাসকষ্ট ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের জন্য দায়ী।

তৃতীয়ত, বায়ুদূষণে উপস্থিত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কার্সিনোজেনিক উপাদান ফুসফুসের কোষে পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

চতুর্থত, শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। দূষিত বায়ু শ্বাসনালীকে দুর্বল করে, ফলে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানা সংক্রমণ সহজেই আক্রমণ করে।

লেখক : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ