রাশিয়ার প্রস্তাবে ওয়াশিংটনের নীরবতা

এম এ হোসাইন

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ইস্যু নিয়ে বিস্ময়কর ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। তবু সম্প্রতি রাশিয়া এমন এক ঘোষণা দিয়েছে, যা যতটা মনোযোগ পাওয়ার কথা ছিল ততটা পায়নি। ২২ সেপ্টেম্বর, ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছেন, মস্কো আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া নিউ স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি (নিউ-স্টার্ট) আরও এক বছরের জন্য বাড়াতে প্রস্তুত। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র চুক্তি। প্রস্তাবটি এসেছে রাশিয়ার পক্ষ থেকে একতরফাভাবে এবং এমন শর্তে যে, ওয়াশিংটন যদি সমানভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় তাহলে ক্রেমলিনও কঠোরভাবে চুক্তি মেনে চলবে।

কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রায় নীরব। হয়তো স্বীকার করলে রাশিয়াকে ‘বেপরোয়া ও সীমাহীন’ হিসেবে দেখানোর প্রচলিত বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। অথচ প্রশ্নটা শঙ্কাজনক- আমরা কি এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি, যেখানে পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার আর কোনো নিয়ম, সীমা বা আস্থাই থাকবে না?

২০১০ সালে বারাক ওবামা ও দিমিত্রি মেদভেদেভ এই নিউ-স্টার্ট চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিটি কখনোই নিখুঁত ছিল না; কিন্তু ঐতিহাসিক ছিল। দুই দেশই কঠোর যাচাই-বাছাই ব্যবস্থার অধীনে, কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেডকে ১,৫৫০-এ সীমিত করতে এবং ৭০০ লঞ্চারে আবদ্ধ থাকতে রাজি হয়েছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে অবাধ অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করেছে।

রাশিয়া নিয়মিত চুক্তির শর্ত মেনে চলেছে- মার্কিন পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে, তথ্য বিনিময় হয়েছে, বড় ধরনের লঙ্ঘন থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। জর্জ ডব্লিউ. বুশ ২০০২ সালে অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইল ট্রিটি থেকে সরে যান। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্স (আইএনএফ) চুক্তি ও ওপেন স্কাইস ট্রিটি থেকে বেরিয়ে আসেন। এসব পদক্ষেপ ঠান্ডা যুদ্ধপরবর্তী সময়ের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে ধ্বংস করেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু। অস্ত্র পরিদর্শন দুর্বল হয়েছে, সংলাপ সীমিত হয়েছে, আর আস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে, এই নিউ-স্টার্ট চুক্তি ভেস্তে গেলে পৃথিবী প্রবেশ করবে, এমন এক যুগে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার কোনো কার্যকরী সীমা থাকবে না।

এইরূপ পরিস্থিতিতে পুতিনের এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে এটি পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে- পারমাণবিক হুমকির জন্য খ্যাত নেতা নিজেই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন! কিন্তু এটি উদারতার চেয়ে বস্তুত কৌশলী এক পদক্ষেপ। রাশিয়া এরইমধ্যে তার পারমাণবিক ত্রিমাত্রিক বাহিনীর ৯০ শতাংশ আধুনিকায়ন করেছে। তাদের প্রতিরোধে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস রয়েছে। সীমিত থাকার সংকেত দিয়ে পুতিন মূলত একদিকে নিজেকে দায়িত্বশীল দেখাতে চেয়েছেন, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের কাঁধে প্রত্যাখ্যানের দায় চাপানোর সুযোগ নিচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালে সীমিত হলেও সংলাপের ক্ষেত্র খোলা থাকবে। আর প্রত্যাখ্যান করলে রাশিয়া দাবি করতে পারবে, তারা চেষ্টা করেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই মস্কো নিজেকে ধ্বংসাত্মক নয় বরং স্থিতিশীলতার অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে- যা ইউরোপ, এশিয়া ও গ্লোবাল সাউথে এক ইতিবাচক কূটনৈতিক বার্তা দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল। ইউক্রেন নিয়ে আলোচনার অচলাবস্থার পর ওয়াশিংটন-মস্কো সম্পর্ক এমনিতেই তিক্ত। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাড়তি দাবি হচ্ছে- চুক্তিতে চীনকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নীতিগতভাবে যৌক্তিক হলেও, বাস্তবে এটি অজুহাতমাত্র। চীন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক কাঠামোতে যোগ দেবে না।

ফলে ঝুঁকিটা পরিষ্কার- অসম্ভব বহুপাক্ষিক চুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে বর্তমান দ্বিপাক্ষিক চুক্তিই ভেঙে পড়তে পারে। এতে বেইজিংকে আলোচনায় আনা যাবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধির শেষ সীমাটুকুও উঠে যাবে।

প্রত্যাশিতভাবেই ইউরোপে অনেকে রাশিয়ার এ প্রস্তাবকে দুর্বলতা ভেবে ভুল করছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, চাপ বাড়ালে মস্কো আরও ছাড় দেবে। এটি তাদের মারাত্মক ভ্রান্তি। যে দেশ পুরো পারমাণবিক ভাণ্ডার আধুনিক করেছে, তাকে দুর্বল ভাবা যায় না। শাস্তি বা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় তারা সহজে নতিস্বীকার করবে না। এমন কৌশল ইউরোপকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভঙ্গুর ও বিপজ্জনক নিরাপত্তাহীন পরিবেশে- যা ঠান্ডা যুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি। তখনও অন্তত কিছু নিয়ম ছিল, আজ যদি তা ভেঙে যায়, কাল হয়তো একেবারেই থাকবে না। গত বিংশ শতাব্দী আমাদের শিখিয়েছে রক্ত আর ভয়ের মাধ্যমে। ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল সংকটে বিশ্ব প্রায় পরমাণু কবরের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। দুই সপ্তাহ ধরে নেতারা দ্বিধা, হিসাব আর আতঙ্কের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি হয়েছিল- শত্রু হলেও সংলাপই ছিল বাঁচার একমাত্র পথ। সেখান থেকে এসেছিল সল্ট, স্টার্ট, আর নিউ-স্টার্ট- একে একে তৈরি হয়েছিল এমন সব চুক্তি, যা বিপর্যয়কে দূরে রেখেছিল।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই শিক্ষা ম্লান হয়, চুক্তি ভেঙে যায়। আইএনএফ চুক্তির পতনে ইউরোপ-এশিয়া আবার ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে এসেছে, যেখানে প্রতিক্রিয়ার সময় কয়েক মিনিট মাত্র। ভুলের শুধু একটাই পরিণতি, আর তাহলো বিপর্যয়। নিউ-স্টার্ট ভেঙে গেলে পৃথিবী বিপদের দিকে ভেসে যাবে না, বরং অন্ধভাবে ছুটে যাবে।

নিউ-স্টার্ট ছাড়া পারমাণবিক হুমকির আর কোনো সীমা থাকবে না। শুধু দুই পরমাণু শক্তি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকবে। যে যাচাই, তথ্য বিনিময়, সতর্কতা অন্তত কিছুটা নিশ্চয়তা দিত, সবই বন্ধ হয়ে যাবে। তার অনুপস্থিতিতে উভয় পক্ষ সবচেয়ে খারাপটাই কল্পনা করবে- আর কল্পনা করলেই তার জন্য প্রস্তুতি নেবে। এভাবেই অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এভাবেই ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে।

আর বিপদ শুধু ইচ্ছাকৃতভাবেই নয়, দুর্ঘটনার কারণেও ঘটতে পারে। ভুল সংকেত, ভুল ব্যাখ্যা, মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত এমন কিছু শুরু করতে পারে, যা কেউ কখনোই চায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপ-এশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনকে কারণ দেখিয়ে রাশিয়া এরইমধ্যে তার মধ্য ও স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে। যদি নিউ-স্টার্টও ভেঙে যায়, তবে শুধু উত্তেজনা নয়, উন্মত্ত অস্ত্র প্রতিযোগিতাই ফিরে আসবে। আর সেটা হবে, এমন এক প্রতিযোগিতা, যেখানে বিজয়ী কেউ নয়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।